গত কিছুদিন ধরে জুলাই সনদ বাংলাদেশের রাজনীতির অন্যতম আলোচ্য বস্তুতে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এই বিষয়টি নিয়ে নানাবিধ আলোচনা চলছে। তবে জুলাই সনদ নিয়ে আলোচনার আগে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের একটি গুরু্ত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করা প্রয়োজন। তা হলো বাংলাদেশের সংবিধান। এর সাথে জুলাই সনদের সুনির্দিষ্ট সম্পর্ক আছে।
বাংলাদেশের যখন জন্ম হয়েছিল তখন বলা হয়েছিল, আমাদের সংবিধান হবে বিশ্বমানের যা দেশের নাগরিকদের রক্ষাকবচ হবে। একটা দেশের সংবিধানের প্রধান ফাংশনই হলো জনগণের অধিকার নিশ্চিত করা। সংবিধান এই কাজ সরাসরি করে না বরং এতে বেশ কিছু ধারা থাকে যার মাধ্যমে সরকার, কোনও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, এবং কোন ব্যক্তি নাগরিকদের অধিকার ক্ষুণ্ন করতে পারে না। কোন রাজনৈতিক দল চাইলেও এমন কোনও আইন প্রণয়ন করতে পারে না, যার মাধ্যমে নাগরিকদের অধিকার ক্ষুণ্ন হয়। একটি সুস্থ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এটাই নিয়ম। এখন সুস্থ গণতন্ত্র বিষয়টি কি?
বাংলাদেশে একটি বহুল প্রচারিত ধারণা হলো গণতন্ত্র মানেই ৫ বছরে একবার ভোট হওয়া। কিন্তু গণতন্ত্র মানেই কি শুধু ভোট? গণতন্ত্রের মূলমন্ত্র হলো জবাবদিহিতা। এই জবাবদিহিতা আসে মূলত ক্ষমতার ভারসাম্য থেকে। পলিটিক্যাল সায়েন্স আর আইনশাস্ত্রে এটাকে বলে ক্ষমতার ভারসাম্য তত্ত্ব বা Theory of Separation of Powers and Checks & Balances). এই থিওরি অনুযায়ী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে তিনটি প্রধান অঙ্গ থাকে—
১. সংসদ (Legislature) যা আইন প্রণয়ন করে।
২. কার্যনির্বাহী বিভাগ (Executive) – যা আইন বাস্তবায়ন করে।
৩. বিচার বিভাগ (Judiciary) – যা আইন ব্যাখ্যা করে ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে।
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ক্ষমতার ভারসাম্য তত্ত্ব অনুযায়ী আইনসভা, কার্যনির্বাহী ও বিচার বিভাগকে একে অপরের উপর নিয়ন্ত্রণ ও জবাবদিহি তৈরি করার মাধ্যমে একটি ভারসাম্য রক্ষা করতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশের সংবিধানের নকশা ও তার বাস্তব প্রয়োগে এই ভারসাম্য দুর্বল হয়ে পড়েছে। প্রথমত, কার্যনির্বাহী বিভাগ সংবিধানে অত্যন্ত প্রভাবশালী। প্রধানমন্ত্রী একই সঙ্গে সরকারের প্রধান ও সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হওয়ায় কার্যত আইনসভা ও নির্বাহীর ক্ষমতা এক জায়গায় কেন্দ্রীভূত হয়। এর ফলে সংসদ অনেক সময় স্বাধীনভাবে আইন প্রণয়ন বা সরকারের কার্যকলাপের ওপর নজরদারি করতে পারে না, বরং নির্বাহীর ইচ্ছা বাস্তবায়নের মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায়। অথচ বাংলাদেশে রাষ্ট্রের জন্মের সময় বলা হয়েছিল সংবিধানের ডিজাইন ক্ষমতার ভারসাম্য তত্ত্ব মাথায় রেখে করা হবে।
কিন্তু সেসময়কার ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ সরকার এর বদলে সংবিধানে ৭০ অনুচ্ছেদের মত ভুতুড়ে আইন রাখে যা বিশ্বে নজিরবিহীন। এই ৭০ অনুচ্ছেদের বলে প্রধানমন্ত্রী চাইলে একজন সাংসদকে বিল পাশের সময় নিজ দলের বিপক্ষে ভোট দিলে বহিষ্কার করতে পারবেন। আবার পৃথিবীর সব দেশেই সাংসদীয় কমিটির মাধ্যমে কেবিনেটে মন্ত্রীদের নিয়ন্ত্রণ করা হয় এবং তাদের সব সিদ্ধান্তকে জবাবদিহিতার মাধ্যমে আনা হয়। কিন্তু এই ৭০ অনুচ্ছেদের কারণে সাংসদরা কেবিনেটের বিপক্ষে যেতে ভয় পান কারণ প্রধানমন্ত্রীর হাতে রয়েছে তাদের বহিষ্কারের ক্ষমতা। আবার বিচারপতি নিয়োগ দেন যে রাষ্ট্রপতি তিনি নির্বাচিত হন সাংসদদের ভোটে যারা কিনা প্রধানমন্ত্রীর পুতুল, ফলে রাষ্ট্রপতি বিচারপতি নিয়োগের সময় প্রধানমন্ত্রীর ইশারার বাইরে যেতে পারেন না। ফলে বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীরা হয়ে যান অসীম ক্ষমতাধর শাসক, যাকে অনেক আইনজ্ঞরা বলেন ইলেক্টোরাল ডিক্টেটরশীপ। বাংলাদেশে আসলে সেই অর্থে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান হওয়ার মত ভোটবাদে আর কিছুই ছিল না। আমাদের সাংবিধানিক কাঠামোই শেখ হাসিনাকে স্বৈরশাসক হতে সাহায্য করে। তিনি ক্ষমতায় থাকার সময় বাংলাদেশে গণতন্ত্রের একমাত্র সম্বল নির্বাচন ব্যবস্থা ধ্বংস করে দেন। ফলে বাংলাদেশ ইলেক্টোরাল ডিক্টেটরশীপ থেকে পরিণত হয় পূর্ণাঙ্গ স্বৈরতন্ত্র্রে। যার পতন ঘটাতে প্রাণ দিতে হয়েছে শতশত ছাত্র-জনতাকে।
জুলাই বিপ্লবের এই তিক্ত অভিজ্ঞতা আমাদের আবারও বাংলাদেশের সংবিধানের এসব দুর্বলতার সামনে নিয়ে এসেছে। আর এখানেই জুলাই সনদের আগমন। জুলাই সনদ কি? এক কথায় বললে জুলাই সনদ বা জাতীয় সনদ হলো মৌলিক সংস্কার সংশ্লিষ্ট দলিল। অভ্যুত্থানের পর সরকার পরিচালনা কাঠামো থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের দাবি ওঠে। এ জন্য সংবিধান থেকে শুরু করে পুলিশ বাহিনী পর্যন্ত সংস্কারের লক্ষ্যে বিভিন্ন কমিশন গঠন করে সরকার। এসব কমিশন এরই মধ্যে সংস্কার প্রস্তাব জমা দিয়েছে। এসব সংস্কার বাস্তবায়নের জন্য দরকার রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত। এ কারণে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করা হয়। যেটির কাজ বিভিন্ন ক্ষেত্রের সংস্কার প্রস্তাবগুলোর ওপর রাজনৈতিক ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা। অর্থাৎ, দলগুলোর মতামতের ভিত্তিতে বিভিন্ন সংস্কার প্রস্তাব চূড়ান্ত করা। প্রস্তাবগুলো চূড়ান্ত হলেই তা একটি সনদ বা চার্টার আকারে প্রকাশ করা হবে। অর্থাৎ, বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার প্রস্তাবের চূড়ান্ত রূপই হবে জুলাই সনদ বা জাতীয় সনদ। এই সনদে বলা থাকবে, কী কী সংস্কার কীভাবে হবে।
গত ৬ জুন জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে জুলাই সনদ কী তা নিয়ে একটি ব্যাখ্যা দেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, ‘জুলাই সনদ হলো একটি প্রতিশ্রুতি। একটা জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্র নির্মাণের জন্য সংস্কার কমিশন যে প্রস্তাবগুলো দিয়েছে, সেগুলোর মধ্য থেকে রাজনৈতিক দলগুলো যে’কটিতে একমত হয়েছে, তার তালিকা থাকবে এই সনদে।’আপাতদৃষ্টিতে জুলাই সনদ বাংলাদেশে কার্যকর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার একটি মাধ্যম হিসেবে দেখা যাচ্ছে।
তবে এই জুলাই সনদ একই সাথে বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক বির্তক উসকে দিচ্ছে। যেমন এই সনদের আওতায় বিএনপি রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার কিছু ভারসাম্য আনতে রাজি। তবে এমন ভারসাম্য চায় না, যেখানে সরকারপ্রধান তথা প্রধানমন্ত্রীর হাতে পর্যাপ্ত ক্ষমতা থাকবে না। দলটি মনে করে, সার্বিক বিবেচনায় সংসদীয় গণতন্ত্রে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য প্রধানমন্ত্রীর হাতে পর্যাপ্ত ক্ষমতা থাকা প্রয়োজন। রাষ্ট্রপতিকে ব্যাপকভাবে ক্ষমতায়িত করা হলে সংসদীয় গণতন্ত্র তেমন অর্থবহ থাকবে না। তাছাড়া প্রধানমন্ত্রীর হাতে যথেষ্ট ক্ষমতা না থাকলে সংসদীয় গণতন্ত্র অকার্যকর হয়ে পড়বে। এছাড়া দলটি জুলাই সনদকে সংবিধানের উপর প্রাধান্য দিতে আপত্তি জানিয়েছে। এখানে বাকি দলগুলোর সাথে বিএনপির দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে।
আবার খসড়ায় উল্লেখ আছে, আগামী নির্বাচনের পরবর্তী দুই বছরের মধ্যে এসব সংস্কার বাস্তবায়নের অঙ্গীকার থাকবে। তবে এখানে জামায়াত আর এনসিপি বাধ সেধেছে, বিএনপির দিকে ইঙ্গিত করে তারা বলছে রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় এলে তা বাস্তবায়ন করবে তা নিয়ে সন্দিহান তারা। কারণ, বিদ্যমান ব্যবস্থা তাদের অসীম ক্ষমতা দিয়ে রেখেছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিবেচনায় এটা সত্য কারণ বিএনপি এই মুহূর্তে দেশের সবচেয়ে বড় দল এবং নির্বাচন হলে তারা ক্ষমতায় আসছে এটি একরকম নিশ্চিত। তবে জামাত বা এনসিপিও এই সনদকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে দেখছে। যেমন এনসিপি বলছে জুলাই ঘোষণাপত্র, নির্বাচনের সময় নির্ধারণসহ বিভিন্ন বিষয়ে বিএনপির চাওয়াকেই প্রাধান্য দিয়েছে সরকার। তারা জুলাই ঘোষণাপত্র না হলে নির্বাচন হতে দেবে না বলে চাপ দিচ্ছে। এনসিপির বিতর্কিত নেতা নাসির পাটোয়ারি এ নিয়ে হুংকার দিয়েছেন।
এখন আমাদের আলোচনার শুরুতে আসা যাক, বাংলাদেশে ক্ষমতার ভারসাম্য জুলাই সনদের মাধ্যমে আসছে কি না? আমাদের প্রথম আলোচ্য বিষয় ছিল ৭০ অনুচ্ছেদ। জুলাই সনদের ফলে ৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের পরিবর্তে সংশোধন করার কথা বলা হচ্ছে। যেখানে সাংসদরা চাইলে তাদের দলীয় অবস্থানের বাইরে ভোট দিতে পারবেন তবে তা অর্থবিল, অনাস্থা প্রস্তাব ও সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। উপমহাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি বিবেচনা নিলে আপাতত এটাই ভাল সিদ্ধান্ত।
আবার এই সনদের আওতায় সংসদে উচ্চকক্ষ হতে যাচ্ছে, যা অনেক দেশে ক্ষমতার ভারসাম্য আনতে প্রয়োগ করা হয়েছে। সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী, নিম্নকক্ষে (সংসদ) নির্বাচন হবে বিদ্যমান পদ্ধতিতে, আসনভিত্তিক। আর উচ্চকক্ষে (সিনেট) নির্বাচন হবে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব বা পিআর পদ্ধতিতে। অর্থাৎ নিম্নকক্ষে সাধারণ নির্বাচনে একটি দল সারা দেশে যত ভোট পাবে, তার অনুপাতে দলটি উচ্চকক্ষে আসন পাবে। তবে বিএনপি এতে রাজি নয়, তারা নিম্নকক্ষের আসনের অনুপাতে উচ্চকক্ষে আসন দিতে আগ্রহী। ফলে এই ইস্যতেও বাকি দলগুলোর সাথে তাদের অনৈক্য সৃষ্টি হয়েছে। তবে নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে বাংলাদেশে উচ্চ কক্ষের প্রয়োজনীয়তা নেই। কারণ, একমাত্র সংবিধান সংশোধন বাদে আর কিছুতেই উচ্চ কক্ষের ক্ষমতা নেই। যা পৃথিবীর অন্য দেশের সাথে মিলে না। এভাবে ক্ষমতার ভারসাম্যও সম্ভব হবে না।
পরিশেষে এটা বলা যায় একটি স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের পর সব দেশেই রাজনৈতিক সংকট হয়। এ ধরনের পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায় হলো স্বৈরচার সৃষ্টি হওয়ার পথ রু্দ্ধ করে দেয়। সংস্কার কমিশনের অধিকাংশ প্রস্তাবই সাধারণ বুদ্ধিতে গ্রহণযোগ্য প্রগতিশীল সংস্কার। এগুলোর লক্ষ্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও স্বাধীন করা এবং প্রধানমন্ত্রীর হাতে কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা কমানো। এই কাজে এই মুহূর্তে বেশি প্রয়োজন পারস্পরিক আস্থা আর শ্রদ্ধাবোধ। বড় দল হিসেবে বিএনপির দায়িত্ব বেশি। তাদের আস্থা অর্জন করতে হবে যে তারা আসলেই দেশের মানুষের পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষাকে সম্মান করে। আর এনসিপিসহ বাকিদলগুলোর কাজ অহেতুক বিতর্ক উসকে না দিয়ে, সেনাবাহিনী বা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে আক্রমণ বাদ দিয়ে ক্রিটিকালি এসব প্রস্তাব নিয়ে কাজ করা। জুলাই সনদ বাস্তবায়নে বিএনপির ব্যর্থতা তাদের জন্য সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিতে পারে বড় দল হয়ে উঠতে। এনসিপি কি তা পারবে?
জুলাই সনদ বাংলাদেশের জন্য কতটা প্রাসঙ্গিক? কতটা জরুরি?
জাহিদ হাসান জুয়েল | রাজনৈতিক বিশ্লেষক
97