জুলাই বিপ্লবের পর দায়িত্ব নেওয়া বর্তমান সরকার অর্থনীতিকে সচল করতে একের পর এক উদ্যোগ নিচ্ছে। আর্থিক খাতে স্থিতিশীলতা ফেরানোর পাশাপাশি এখন জোর দেওয়া হচ্ছে বাস্তব উন্নয়নের মূল ভিত্তি শিল্পায়নের ওপর। এই লক্ষ্য বাস্তবায়নে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) একটি ভিন্নধর্মী কিন্তু সময়োপযোগী পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে—বন্ধ হয়ে যাওয়া রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পপ্রতিষ্ঠানের অব্যবহৃত জমিকে অর্থনৈতিক অঞ্চলে রূপান্তর।
এই পরিকল্পনার অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু ঢাকার ডেমরায় শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে অবস্থিত করিম জুট মিলস লিমিটেড। একসময় দেশের গুরুত্বপূর্ণ পাটকলগুলোর একটি হলেও দীর্ঘদিনের অব্যবস্থাপনা, আধুনিকায়নের অভাব ও বাজার সংকোচনের কারণে মিলটি বন্ধ হয়ে পড়ে। বর্তমানে এর বিশাল অবকাঠামো কার্যত পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে, যা ধ্বংসের ঝুঁকিতে পড়েছে।
ঠিক এই প্রেক্ষাপটেই বেজা পরিচালিত সম্ভাব্যতা যাচাই প্রতিবেদন নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে। প্রতিবেদনে করিম জুট মিলস এলাকাকে সরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবে উন্নয়ন ও পরিচালনার জন্য অত্যন্ত উপযোগী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বাস্তবায়ন করা গেলে এটি শুধু একটি মিলের পুনর্জন্ম নয়, বরং জাতীয় অর্থনীতিতে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ঐতিহাসিক এই শিল্পাঞ্চলে প্রায় ৪৯.৬৩ একর বা ২,০০,৮৪৫.৬৬ বর্গমিটার জমি দীর্ঘদিন ধরে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের বাইরে ছিল। অন্যদিকে, দেশে নতুন শিল্প স্থাপনের জন্য উদ্যোক্তা ও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে উপযুক্ত জমির চাহিদা বাড়ছিল। বেজার সমীক্ষা অনুযায়ী, এই অব্যবহৃত জমিকে শিল্প প্লটে রূপান্তর করা গেলে তা শিল্পায়নের নতুন সুযোগ সৃষ্টি করবে। করিম জুট মিলস ছাড়াও বেজার বৃহত্তর পরিকল্পনায় কুষ্টিয়া সুগার মিলস লিমিটেড ও কুষ্টিয়ার মোহিনী টেক্সটাইল মিলস লিমিটেডকে অর্থনৈতিক অঞ্চলে রূপান্তরের চিন্তাভাবনাও রয়েছে।
করিম জুট মিলসকে ঘিরে আশাবাদের বড় কারণ এর অবস্থান ও অবকাঠামোগত সুবিধা। মিলটি ডেমরায় শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে অবস্থিত এবং সুলতানা কামাল সেতুর ডেমরা অংশের ব্রিজ এপ্রোচের পাশে থাকায় ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ সারা দেশের সঙ্গে সহজ যোগাযোগ নিশ্চিত করে। নদীপথে মিলসংলগ্ন জেটি ব্যবহার করে চট্টগ্রাম বন্দরের সঙ্গে পণ্য পরিবহন করা সম্ভব, যা লজিস্টিক সুবিধার দিক থেকে বড় একটি প্লাস পয়েন্ট। এই বহুমুখী যোগাযোগ ব্যবস্থা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্যও প্রকল্পটিকে আকর্ষণীয় করে তুলতে পারে।
এ ছাড়া এখানে বিদ্যমান ইউটিলিটি সুবিধা অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার খরচ কমিয়ে আনবে। মিল এলাকায় ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির অবকাঠামো রয়েছে এবং কাছেই তিতাস গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির অফিস অবস্থিত। বর্তমানে দুইটি ট্রান্সফরমারসহ একটি সাব-স্টেশন চালু রয়েছে, যা হালকা শিল্পের বিদ্যুৎ চাহিদা মেটাতে সক্ষম। উৎপাদন বন্ধ থাকায় গ্যাস সংযোগ সাময়িকভাবে বিচ্ছিন্ন থাকলেও তা পুনরায় চালু করা সম্ভব।
জমির পরিকল্পিত ব্যবহারও এই প্রকল্পের আরেকটি শক্তি। মোট জমির প্রায় ৬৫ শতাংশ প্রসেসিং এলাকা হিসেবে কারখানা স্থাপনের জন্য ব্যবহার করা যাবে। বাকি অংশে অফিস, আবাসন, সড়ক, ড্রেনেজ, জলাশয় ও সবুজায়নের ব্যবস্থা থাকবে। পাশাপাশি মিল ও গোডাউন এলাকার প্রায় ৩৬ হাজার বর্গমিটার স্থাপনা সংস্কার করে তৈরি কারখানা ভবন হিসেবে বিনিয়োগকারীদের ভাড়া দেওয়া সম্ভব হবে। এতে নতুন উদ্যোক্তাদের প্রাথমিক বিনিয়োগের চাপ অনেকটাই কমবে।
প্রকল্পটির সম্ভাব্য বিনিয়োগ ব্যয় ধরা হয়েছে ২০০ থেকে ৩০০ কোটি টাকা। বিপরীতে বাৎসরিক আয় প্রবাহ হতে পারে প্রায় ১৮.৫২ কোটি টাকা পর্যন্ত। তবে এর সবচেয়ে বড় অবদান হবে কর্মসংস্থান। বেজার হিসাব অনুযায়ী, এই অর্থনৈতিক অঞ্চলে প্রত্যক্ষভাবে প্রায় ২৫ হাজার এবং পরোক্ষভাবে প্রায় ৪০ হাজার মানুষের কাজের সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে। এর মধ্যে প্রায় ১৭ হাজার ৫০০ জন নারী শ্রমিকের কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা রয়েছে, যা মোট কর্মসংস্থানের প্রায় ৭০ শতাংশ।
এখানে তৈরি পোশাক শিল্পের পাশাপাশি ফেব্রিক্স, জিপার, বাটন, সুতা, লেবেলসহ পশ্চাৎ সংযোগ শিল্প এবং হালকা ইলেকট্রনিক অ্যাসেম্বলিং শিল্পকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। এর ফলে রপ্তানি পণ্যের বৈচিত্র্য বাড়বে এবং বেজার ধারণা অনুযায়ী এখানকার শিল্প থেকে রপ্তানিতে প্রায় ৬৫ শতাংশ পর্যন্ত অবদান রাখার সুযোগ তৈরি হতে পারে।
নীতিনির্ধারকদের আশা, করিম জুট মিলসকে ঘিরে এই উদ্যোগ সফল হলে তা শুধু একটি বন্ধ মিলকে নতুন জীবন দেবে না, বরং আগামী কয়েক দশকে বাংলাদেশের অর্থনীতির কাঠামোগত পরিবর্তনের একটি শক্ত ভিত্তি তৈরি করবে।
