বাংলাদেশের রাজনীতি এখন অনেক জটিল রূপে আবর্তিত। দেশের আইনশৃংখলার চরম অবনতিতে প্রতিদিন যা দেখছি, তাতে করে মনে হয় কোথাও কেউ নিশ্চিত হতে পারছে না এরপর কী আছে, কী ঘটবে? এমন তো হবার কথা ছিলো না। কেউ আকাঙ্খাও করেনি এমন এক অনিশ্চিত গতিপথ। কিন্তু এর পেছনে একটি বড় কারণ বলে প্রতিয়মান, তা হলো, সরকারের নির্বাহী অংশ এবং সামরিক বাহিনীর মাঝে বিপুল সমন্বয়হীনতা। পরস্পর যেনো দূর দূরত্বে অবস্থান করছে। এ কথায় কারো যদি মনে হয়, এটি ভ্রান্তি; তবে বলবো হিসেব করেন, অনুধাবন করেন, উত্তর পেতে সময় লাগবে না।
এই সমন্বয়হীনতার পেছনে একটি অন্যমত কারণ হতে পারে, গত আগষ্টে শেখ হাসিনা সরকারের একরোখা ফ্যাসিস্ট প্রশাসনিক ব্যাবস্থাপনার অবসান হলে ড ইউনুসের নেতৃত্বে যে সরকার গঠিত হলেঅ, সেটিকে একান্তভাবে ছাত্রশক্তি দ্বারা অনুমোদিত এবং নিয়োগকৃত সরকার হিসেবে তার দিক থেকে প্রকাশ্যে স্বীকৃতি প্রদান। এরফলে অন্য কোনো শক্তিকে অনুমোদন না দেয়ায় রাষ্ট্রের নিরাপত্তায়, জনগণের স্বার্বভৌম আকাঙ্খাকে সুরক্ষা দিতে বর্তমান সরকার একা হয়ে পড়ছে। যে বাহিনী সাংবিধানিকভাবে শপথ নিয়েছে রাষ্ট্র সুরক্ষায়, একমাত্র সেই প্রাতিষ্ঠানিক শক্তিতে জনপ্রশাসনের মূল নির্বাহীগণ বা সুনির্দিষ্ট করে ড ইউনুস মনে করলেন, রাষ্ট্র পরিচালনায় তাদের এমন কোনো ভূমিকার অবকাশ নেই যেখানে রাষ্ট্রের দুঃসময়ে বা জনতার প্রয়োজনে তাদেরকে পাশে দরকার। রাষ্ট্র পরিচালনায় তারা সরকারকে উপদেশ বা সহায়তা দিক সবসময়। সরকার ধরেই নিয়েছে, সামরিক বাহিনী শুধু মাত্র প্রচলিত পন্থায় দূরে বসে থাকবে। এটিই তাদের ভূমিকা। এর বাইরে কিছু নয়। বলা যায়, এমন ভাবনা হতে পারে গ্রহনীয় যদি একটি স্বাভাবিক পরিস্থিতি বিরাজ করে। কিন্তুসে রকম পরিস্থিতিতে দেশ কি এখন চলমান? নিশ্চয়ই তা নেই।
অবশ্যি, সরকারের এই মনোভাবনার সাথে আরও একটি উপাদান কার্যকর বলেও ধারণা করা যায়, তা হলো সামরিক বাহিনীর এখনকার কমা- বিগত শাসক শেখ হাসিনার দ্বারা নিয়োগকৃত বলে তাদের প্রতি বর্তমান নির্বাহী শক্তির অবিশ্বাস। অবিশ্বাসটা এমন, “তলে তলে এরা শেখ হাসিনার লোক। এদের বিশ্বাস করা যাবে না।” কিন্তু সত্যটা কী এমন নয়, সামরিক বাহিনীই ছাত্রদের সাথে সমন্বিতভাবে ড ইউনুসকে ক্ষমতায় বসাতে পূর্ণ সহায়তা করেছে। সামরিক বাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার উজ জামান সেদিন ইচ্ছে করলেই শাসন ক্ষমতা সামরিক বাহিনী কাছে ধরে রাখতে পারতেন। কিন্তু তিনি চেয়েছেন বাংলাদেশ একটি সঠিক গণতান্ত্রিক পথে থাকুক এবং এই নতুন সরকার জনগণের সেবা করুক ন্যায় বিচারের ভিত্তিতে। অথচ কী ঘটলো বা ঘটেই চলেছে? ড ইউনুস পরিচালিত সরকারের দিক থেকে চূড়ান্ত অবিশ্বাস সামরিক বাহিনীর প্রতি দৃশ্যমান। সেই অবিশ্বাস থেকেই সামরিক বাহিনীর মাথার উপর একজন বিদেশী নাগরিক, যার কীনা সামরিক নিরাপত্তা বিষয়ে ন্যূনতম অভিজ্ঞতা নাই, তাকে বানিয়ে দিয়েছে নিরাপত্তা উপদেষ্টা। এর ফলে, বেসামরিক এবং সামরিক প্রশাসনের মাঝে সৃষ্টি হয়েছে প্রকট সমন্বয়হীনতা।
এমন এক পরিস্থিতিতে কেউ কেউ ২০০৭ সালে জানুয়ারির ওয়ান ইলেভেন সরকারের সাথে কিছু ধারায় তুলনা করেন। কী দেখেছি তখন? রাষ্ট্র পরিচালনায় সেদিন বিএনপি সরকারের চূড়ান্ত ব্যর্থতার প্রেক্ষিতে সামরিক বাহিনী এসেছিলো এগিয়ে। রাষ্ট্রীয় অচলাবস্থা, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও নৈরাজ্যের মুখে একটি কার্যকর ও সমন্বিত রাষ্ট্র কৌশলই ছিলো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার মূল মন্ত্র। সেনাবাহিনী, পুলিশ, সকল গোয়েন্দা সংস্থা ও বেসামরিক প্রশাসনের সম্মিলিত কার্যক্রমই সে সময়কার সংকটের মোক্ষম উত্তর দিতে সক্ষম হয়েছিল। বর্তমান সময়ে, ২০২৫ সালের প্রেক্ষাপটে ফিরে তাকালে সেই ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা আমাদের সামনে এক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলে ধরে। আমরা কি আজ রাষ্ট্রযন্ত্রের মধ্যে সেই ঐক্য, সমন্বয় এবং পারস্পরিক আস্থা লক্ষ্য করছি?
আজকের বাস্তবতায় স্পষ্ট হয়ে উঠছে, ড ইউনুস সরকারের মধ্যে সেই রকম সমন্বয় ব্যবস্থার ঘাটতি রয়েছে। বিশেষত সামরিক বাহিনী ও অন্যান্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কার্যকর সংলাপ ও আস্থা বিনিময়ের ক্ষেত্র অনুপস্থিত। দেশে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা, সামাজিক বিভ্রান্তি এবং নানা শ্রেনী পেশার অবস্থান থেকে আন্দোলন মোকাবিলায় সরকার কার্যত একক সিদ্ধান্তের পথ অনুসরণ করছে। ধারণা করা যায়, দীর্ঘমেয়াদে এটি জাতীয় নিরাপত্তার জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে।
ওয়ান ইলেভেনের সময়ের অভিজ্ঞতা বলে দেয়, একটি সরকার যখন রাষ্ট্রযন্ত্রের সবগুলো স্তরের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে, তখনই একটি ভারসাম্যপূর্ণ, স্থিতিশীল ও নিরাপদ রাষ্ট্র পরিচালনা সম্ভব হয়। সেনাবাহিনীর শুধু যুদ্ধক্ষেত্রে নয়, বরং জাতীয় দুর্যোগ, রাজনৈতিক সংকট বা সামাজিক অস্থিরতার সময়েও তাদের সাংগঠনিক দক্ষতা ও পেশাদারিত্ব যে কতটা কার্যকর হতে পারে, তা আমরা ঐ সময়েই দেখেছি। যদিও এটাও সত্য, সেই সফলতা এক পর্যায়ে ব্যর্থতায় রূপ নেয়। কিন্তু, সেখানেও বলবো, এর জন্যে তখনকার সিভিল প্রশাসন বহুলাংশে দায়ি। আসলে যে কোনো সফলতার পেছনে দরকার সমন্বয় এবং সুবিবেচনা। জনগণের প্রতি দায়বোধ। কিন্তু বর্তমান সরকারের রাজনৈতিক অনভিজ্ঞতার পাশাপাশি একধরণের আত্মতুষ্টি ও আত্মকেন্দ্রিকতা প্রকট। এই আচরণ রাষ্ট্রের বাকি অংশগুলোকে কোণঠাসা করে ফেলছে।
গত কয়েকদিনের ঘটনাবলি, বিশেষত গোপালগঞ্জে এনসিপি যাত্রার আগে দলের শীর্ষ নেতাদের যুক্তিহীন বক্তব্য, ওখানকার স্থানীয় জনগণকে উস্কে দেবার মতো করে কথাবার্তা। এরফলে আওয়ামী লীগের জন্যে এনসিপির উপর হামলার সুযোগ। সার্বিকভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বলপ্রয়োগ, রাজধানীতে শিক্ষার্থীদের সাথে পুলিশের সংঘাত; এখানেও অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ। দেখা যাচ্ছে, প্রতিটি ঘটনায় সেনাবাহিনীকে জড়িয়ে ফেলা এবং তাদের ভূমিকা নিয়ে নানা ধরনের গুজব ও অপপ্রচার সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করছে। কেনো এমন ঘটছে? নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারের অভ্যন্তরে গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর সঙ্গে দুর্বল সমন্বয়। এই সুযোগে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে কিছু ইউটিউবার ইলিয়াস, পিনাকী, বা কনকের মতো সোশ্যাল মিডিয়া ভিত্তিক চরিত্র সেনাবাহিনী চরিত্র হনন করছে। জনগণকে বিভ্রান্ত করছে এবং সেনাবাহিনী ও পুলিশের মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টির প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
মনে রাখতে হবে সেনাবাহিনী কখনো কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতিপক্ষ নয়, বরং তারা দেশের সার্বভৌমত্ব ও স্থিতিশীলতার রক্ষাকবচ। নানাভাবে দেশ এখন নাজুক পরিস্থিতিতে। সেজন্যে দরকার গণতান্ত্রিক সরকার ও সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে সহযোগিতা, আস্থা এবং স্বচ্ছতা বজায় রাখা। একইসাথে প্রয়োজন প্রতিটি সংকটে সেনাবাহিনীর পেশাদারিত্বের প্রতি আস্থা রেখে সম্মিলিত পদক্ষেপ গ্রহন।
সেনাবাহিনী বা গোয়েন্দা সংস্থার সতর্কবার্তা উপেক্ষা করে সরকার যদি এককভাবে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়ে দেশ পরিচালনার চেষ্টা চালিয়েই যায়, তবে ভবিষ্যতে তার মাশুল দিতে হতে পারে জনগণকেই। বিশেষ করে সামাজিক মিডিয়ায় যেভাবে বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ানো হচ্ছে, সেসবের প্রতিক্রিয়ায় একটি পেশাদর প্রতিষ্ঠাণ হিসেবে সামরিক বাহিনীর ক্ষতি শেষতক দেশের নিরাপত্তা ব্যাস্থায় সংকট তৈরী করবে বলেই ধারণা করা যায়।
বর্তমান সময়ের বাস্তবতায় যে বার্তাটি সামনে চলে আসে, তা হলো, জাতীয় স্বার্থে একটি কার্যকর, প্রাজ্ঞ ও দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন নেতৃত্বের বিকল্প নেই। সুতরাং, রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে যারা আছেন, তাদের উচিত জাতীয় স্বার্থে সামরিক বাহিনী, সকল গোয়েন্দা সংস্থা এবং প্রশাসনের সঙ্গে একটি কার্যকর ও আন্তরিক সমন্বয় গড়ে তোলা। তা না হলে চলমান রাজনৈতিক সংকট ক্রমান্বয়ে রূপান্তরিত হবে জাতীয় নিরাপত্তা হুমকিতে। যার প্রতিক্রিয়া স্বরূপ একটি দীর্ঘস্থায়ী সংকট সৃষ্টি হতে পারে দেশ এবং জনগণের জন্যে। আমরা সকলেই চাই, একটি সঠিক এবং সুস্থ্য ধারার বিকাশ। এমন একটি ইতিবাচক ধারা যেখানে দাঁড়িয়ে আলোর প্রত্যাশা করবে জনগণ।
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক, কবি ও কথাসাহিত্যিক।