বাংলাদেশে সামরিক বাহিনী বাংলাদেশের গর্বের প্রতীক শুধু নয়, স্বার্বভৌমত্ব সুরক্ষায় একমাত্র শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান। একইসাথে যে কোনো দুর্যোগ মোকাবিলা, এবং অবকাঠামো উন্নয়নসহ বহিঃবিশ্বে শান্তিরক্ষায় তারা প্রশংসিত। কিন্তু সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে দেখা যাচ্ছে, জনগণের একটি বড় অংশ বিশেষ করে এখনকার এই অস্থির তরুণ প্রজন্মের অনেকেই সামরিক বাহিনীর প্রতি আস্থাহীনতা ও ক্ষোভ প্রকাশ করছে।
এমন মানসিকতারই প্রকাশ লক্ষ্য করা যাচ্ছে যখন ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এবং বিমান বাহিনীর সদর দফতর সরিয়ে নেওয়ার দাবি উঠে আসে। কিন্তু কেনা এমন দাবি? দেখা যাচ্ছে , এই দাবিটি এক ধরনের পুনরাবৃত্ত প্রতিধ্বনি, যা সময়ে সময়ে বিভিন্ন অজুহাতে সামনে আসে। সাম্প্রতিক উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটি প্রশিক্ষণরত যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়ে হতাহতের ঘটনাকে কেন্দ্র করে আবারও এই দাবির পুনরাবৃত্তি দেখা যাচ্ছে। মাইলষ্টোন স্কুলের যুদ্ধবিমান বিদ্ধস্ত হওায় অসংখ্য শিশু শিক্ষার্থী নিহত হওয়ায় পুরো দেশ শোকাহত, বেদনাবিধুর। কিন্তু শোকের আবরণে রাজধানী থেকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট সরিয়ে ফেলো, এমন দাবির তুলছে অনেকে এবং এর ভেতর নিঃসন্দেহেই এক ধরনের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চলে আসছে বলেই বিশ্বাস।
একটি প্রশ্ন বারবার উঠে আসছে: জনবহুল শহরের মাঝখানে সামরিক ঘাঁটি থাকা উচিত কিনা? কেন ঢাকায় সামরিক বিমান প্রশিক্ষণ চলে? অভিযোগ উঠছে, সেনানিবাস এলাকায় সাধারণ মানুষের চলাচল সীমিত, যা নাগরিক অধিকারকে খর্ব করছে। আইনজীবী সারা হোসেন জার্মান রেডিওকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, “সেনানিবাসে যে বিধিনিষেধ আছে, অন্যান্য মানুষ ঢুকতে পারে না, এটা আরও সমস্যাজনক ৷ দুই কাতারের মানুষ কেন থাকবে যারা সেনানিবাসে ঢুকতে পারেন, এবং অন্যরা পারেন না৷ রাস্তাঘাট অন্য সবার জন্য অবরুদ্ধ ৷ অনেকে বলছে, “ঢাকার মতো ঘনবসতিপূর্ণ বেসামরিক এলাকায় সত্যিই কি সামরিক প্রশিক্ষণ করা উচিত?”
এমন বক্তব্য কতটুকু সঠিক ? কতখানি এর ভেতর দূরদর্শিতা রয়েছে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে গেলে বলা দরকার —ঢাকা সেনানিবাস বা কুর্মিটোলা বিমান ঘাঁটি হঠাৎ গড়ে ওঠেনি। এর প্রতিটি সিদ্ধান্ত পরিকল্পিত, নিরাপত্তার প্রয়োজনে এবং ভৌগোলিক বাস্তবতা বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। রাজধানীর কৌশলগত অবস্থান এবং সংকটকালে দ্রুত প্রতিক্রিয়ার জন্য ঢাকায় সামরিক উপস্থিতি অপরিহার্য। যদি এই ঘাঁটিগুলো সরিয়ে নেওয়া হয়, তাহলে দুর্যোগকালীন মুহূর্তে সেনাবাহিনী বা বিমান বাহিনীর তাৎক্ষণিক সাড়া দেওয়ার ক্ষমতা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে।
বিমান বাহিনী কেবল যুদ্ধের প্রস্তুতির বাহিনী নয়। তারা উদ্ধারকাজ, জরুরি চিকিৎসা, প্রশিক্ষণ এবং আন্তর্জাতিক সহায়তায় নিয়মিত অংশ নেয়। কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগে তাদের ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। যারা আজ বিমান বাহিনীর কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন, তারা কি কখনও এই রাজধানীকে কী করে বাসযোগ্য করা সম্ভব, সে নিয়ে দাবি তুলেছেন? তারা কি প্রশ্ন করেছেন, কেনো রাজধানীতে সঠিকভাবে যানবাহন চলাচলের প্রটোকল তৈরী আজও হলোনা। কেনো আজও এই নগরীতে ঘরবাড়ির নির্মাণের সঠিক বিধি মানা হলোনা?
উত্তরার দুর্ঘটনাস্থল ছিল একটি “হোল্ডিং প্যাটার্ন”—যেখানে উড়োজাহাজ অবতরণের আগে চক্কর কাটে। এই এলাকাটি দীর্ঘদিন ধরেই উড়োজাহাজ চলাচলের আওতায়। প্রশ্ন হওয়া উচিত, এই এলাকায় কীভাবে একটি বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠল? কারা অনুমোদন দিল? কেন বিমান চলাচলের বাফার জোন রক্ষা করা হলো না? এই প্রশ্নগুলো এড়িয়ে গিয়ে দোষ চাপানো হচ্ছে বিমান বাহিনীর ওপর। মূলত এটি একটি দায়িত্বজ্ঞানহীন ও বিভ্রান্তিকর দৃষ্টিভঙ্গি।
ঢাকা শহরের সমস্যা সামরিক ঘাঁটি নয়, সমস্যা হলো অপরিকল্পিত নগরায়ন, আবাসন মাফিয়া, দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসন এবং রাজউকের ব্যর্থতা। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় গড়ে ওঠা অবৈধ স্থাপনা, জনবসতির ভিতরে ঝুঁকিপূর্ণ অবকাঠামো এবং নগর পরিকল্পনার দীনতা আমাদেরকে এমন দুর্ঘটনার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। আমরা কি ভুলে গেছি, দেশের সবচেয়ে জনবহুল শহরটির জন্য কোনো দীর্ঘমেয়াদি পরিবহন, হেলথকেয়ার, সিভিক প্ল্যান কখনো সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়িত হয়নি? এসব দুর্বলতার ফলেই শহরের ভেতর দুর্ঘটনার আশঙ্কা তৈরি হয়। অথচ সমাধানের পরিবর্তে আঙুল তোলা হচ্ছে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা স্তম্ভের দিকে।
শহরের ভিতর থেকে বিমান ঘাঁটি সরিয়ে নেওয়ার দাবি এক রকম বাস্তবতা অস্বীকারের নামান্তর। যদি তেজগাঁও কিংবা কুর্মিটোলা বিমান ঘাঁটি সরানো হয়, তাহলে রাজধানীর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার কী হবে? ঢাকার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ব্যবহার করা সম্ভব না হলে, দেশে নতুন করে কি আরেকটি পূর্ণাঙ্গ বিমানবন্দর তৈরি করা যাবে? আমাদের কি সেই অর্থনীতি সক্ষমতা বা রাজনৈতিক সদিচ্ছা আছে? আমরা কি এই দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবস্থার মধ্যে থেকে এমন উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে পারব?
একটি বিষয় ভেবে দেখা জরুরি—বিশ্বের প্রতিটি দেশে সামরিক ঘাঁটিতে দুর্ঘটনা ঘটে। প্রশিক্ষণের সময় ঝুঁকি থেকে যায়, বিশেষ করে যখন একজন নতুন পাইলট এককভাবে উড্ডয়ন করেন। পাইলট তৌকির ইসলাম ছিল একটি সম্ভাবনাময় তারকা। তার মৃত্যু আমাদের ব্যথিত করেছে, এবং একইসাথে মর্মন্তুদ নিঃস্পাপ শিশুদের চির বিদায়। কিন্তু আবেগে ভেসে গিয়ে গোটা ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এখন থেকে সরানোর দাবি অবিবেচনা প্রসূত।
সবচেয়ে দুঃখজনক, মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে ট্র্যাজেডিকে ব্যবহার করে একটি বিশেষ গোষ্ঠী রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্রমূলক প্রচারণায় নেমেছে। তারা গুজব ছড়াচ্ছে, বিভ্রান্তিকর অডিও ফাঁস করছে, বাহিনীর দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে, তাদের ওপর আস্থা নষ্ট করছে। এই প্রচারণা কেবল সেনাবাহিনী নয়, সমগ্র বাংলাদেশের নিরাপত্তা কাঠামোর জন্য হুমকি। এই চক্রান্ত দেশের ভেতরের কিছু চক্রের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিতও বহন করে।
সামরিক ঘাঁটি সরানোর দাবির বিষয়টি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা দুর্বল করার একটি কৌশল মাত্র। এমন পদক্ষেপ কি রাজধানী ঢাকাকে বাসযোগ্য করে তুলবে? আসলে ঢাকাকে সবসাবর যোগ্য করতে হলে দরকার পরিকল্পিত নগরায়ন। এট করতে পারলেই ভবিষ্যতের জন্য নিরাপদ ও কার্যকরী ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব এখানে।
ধরা যাক, ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট সরিয়ে দিলো সরকার। এতে করে এই যে সুবিশাল ভূমি ফাঁকা হবে, সেখানে কোন কোন ভূমিদশ্যূ দখল নিবে এবং তারা কি প্রক্রিয়ায় এখানে গতানুগতিক ধারার অনিরাপদ নগরায়ন করবে? এই যে ক্যান্টনমেন্টের ব্যবহৃত শত শত সুবিশাল ভবন খালি হবে, সেগুলো কোন কাজে লাগানো হবে বা কার ভোগে যাবে? এর মালিকানা কি রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর হবে? না-কি সামরিক বাহিনীর কাছেই থাকবে? আছে কি এসবের উত্তর? কে দেবে এর উত্তর? আমাদের দেশে একটা প্রবনতা পষ্ট, তা হলো, বলতে মন চাইলো,- বললাম। চাইতে ইচ্ছে করলো,- চাইলাম । কিন্তু ঐ বস চাওয়ার, দাবির যৌক্তিক বিচার বিশ্লেষণ করার প্রয়োজন বোধ করে না দাবি উত্থাপনকারিরা।
বিষন্ন মন নিয়ে বলি, মাইলস্টোন স্কুল ট্র্যাজেডি আমাদের কাঁদিয়েছে এবং বুকের মাঝে ভারি শোক সকলেই বহন করছি। কিন্তু সেই শোকের পথ ধরে কেউ যেন অযৌক্তিক প্রতিহিংসার আগুন জ্বালিয়ে দিতে না পারে, সে দিকে সতর্ক হওয়া। আমাদের প্রত্যাশা হলো দুঃসময়ে যুক্তিবাদী, দায়িত্ববান, বাস্তবতানির্ভর নেতৃত্ব এবং পদক্ষেপ। আর যারা দুঃখ, ও বেদনাকে হাতিয়ার বানিয়ে রাষ্ট্রবিরোধী রাজনীতির পেছনে কাজ করে, তাদেরকে প্রত্যাক্ষাণ করা।
- লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক, কবি ও কথাসাহিত্যিক