আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে প্রতিবেশীকে দোষ দেওয়া নতুন কিছু নয়। দিল্লির লালকেল্লা প্রাঙ্গণে ১০ নভেম্বরের বিস্ফোরণের পর ভারত আবার সেই পুরনো কৌশল নিয়েছে। ডেকান ক্রনিকল-এ ১৫ নভেম্বর ২০২৫ তারিখে প্রকাশিত ভিনিতা পান্ডের একটি লেখায় বাংলাদেশ ও এমনকি পাকিস্তানকেও ঘটনাটির সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। সেখানে তিনি দাবি করেছেন, নাকি বাংলাদেশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়বার (LeT) সঙ্গে গোপন বৈঠকে যুক্ত ছিলেন। লেখাটি গোয়েন্দা গল্পের মতো সাজানো হলেও বাস্তবের সঙ্গে এর মিল নেই।
চলুন তথ্য দেখি। পান্ডের অভিযোগের ভিত্তি হলো কথিত এক বৈঠক, যেখানে নাকি LeT কমান্ডার সাইফুল্লাহ সাইফ পাকিস্তান থেকে নির্দেশ দিচ্ছিলেন, আর বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ও ঢাকার মেয়র সেই নির্দেশ নিচ্ছিলেন। আরও দাবি করা হয়েছে যে LeT প্রতিষ্ঠাতা হাফিজ সাঈদ নাকি বাংলাদেশ থেকেই কিছু পরিকল্পনা করছেন। এর মানে দাঁড়ায় বাংলাদেশ সরকার ভারতের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসে জড়িত।
এগুলো শুধু ভুল নয়, দায়সারা এবং বিদ্বেষপূর্ণ। প্রথমত, এমন কোনো বৈঠক ঘটেইনি। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন এই অভিযোগগুলোকে “নির্বিচার ও ভিত্তিহীন” বলেছেন। তিনি স্পষ্ট করেছেন যে বাংলাদেশ তার মাটিকে কখনোই ভারতবিরোধী কাজে ব্যবহার হতে দেয় না। কূটনৈতিক সূত্র ও গোয়েন্দা চ্যানেলগুলো নিশ্চিত করেছে যে যেসব বৈঠকের কথা বলা হচ্ছে সেগুলো ছিল ধর্মীয় বিনিময়, জঙ্গি কার্যক্রম নয়।
তথ্য বলছে, ২৪ অক্টোবর থেকে ৮ নভেম্বর ২০২৫ পর্যন্ত পাকিস্তানের আহলে হাদিস ধারার এক আলেম, ইফতেখার এলাহী, বাংলাদেশে এসেছিলেন স্থানীয় আহলে হাদিস সংগঠনের আমন্ত্রণে এক ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। এ ধরনের ধর্মীয় আদানপ্রদান দক্ষিণ এশিয়ায় সাধারণ ঘটনা। ১৫ নভেম্বর ঢাকায় খতমে নবুয়ত আন্দোলনের একটি শান্তিপূর্ণ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে হাজারো মানুষ অংশ নেয়। বিষয়টি ছিল ধর্মীয়, সন্ত্রাস নয়। বাংলাদেশ সরকার কঠোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করে অনুষ্ঠানটি সম্পন্ন করেছে। শান্তিপূর্ণ এই আয়োজনে LeT গতিবিধি খুঁজে পাওয়া শুধুই অজ্ঞতা নয়, ইচ্ছাকৃত অপপ্রচার।
পান্ডের লেখায় এসব শান্তিপূর্ণ প্রেক্ষাপট পুরোপুরি বাদ দিয়ে ভিন্ন সূত্রের তথ্য টেনে এনে গল্প তৈরি করা হয়েছে। হাফিজ সাঈদের যে মন্তব্য তিনি উদ্ধৃত করেছেন, তা আসলে কয়েক মাস আগের একটি সাধারণ LeT প্রচার ভিডিও থেকে নেয়া, যার সঙ্গে ঢাকার কোনো সম্পর্ক নেই। এটি স্পষ্টভাবে আজগুবি সংযোগ তৈরি করে একটি নির্দিষ্ট বয়ান চাপানোর চেষ্টা।
প্রশ্ন হলো, বিস্ফোরণের পরপরই কেন এমন বয়ান চালু হলো? এটা গোয়েন্দা তথ্য নয়, বরং নিজের ব্যর্থতা আড়াল করার চেষ্টা। ভারতের অতীতেও এমন দেখা গেছে। পাহালগাম হামলার সময়ও পাকিস্তানকে দায়ী করা হয়েছিল, কিন্তু তদন্তে চূড়ান্ত প্রমাণ পাওয়া যায়নি। দিল্লি ব্লাস্টের তদন্তও এখন অভ্যন্তরীণ চক্র এবং নিজস্ব চরমপন্থার দিকে ইঙ্গিত করছে, তারপরও আঙুল তোলা হচ্ছে বাংলাদেশকে।
২০২৪ সালের আগস্টের পর থেকে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে প্রতিরক্ষা ও বাণিজ্য সম্পর্ক বাড়ায় ভারত উদ্বিগ্ন। তাই বাংলাদেশকে সন্ত্রাসের কেন্দ্র হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা স্পষ্টভাবে একটি কৌশল, যা বাংলাদেশের স্থিতি ও আঞ্চলিক প্রভাব কমানোর উদ্দেশ্যে করা হচ্ছে। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায় সামনে থাকায় বাংলাদেশকে বিব্রত করা ভারতের জন্য রাজনৈতিক সুবিধা এনে দিতে পারে।
সময়ের মিলও লক্ষ্য করার মতো। ভারতের অভ্যন্তরে সংখ্যালঘু ইস্যু ও সহিংসতা নিয়ে আন্তর্জাতিক নজর বাড়ছে। এমন সময়ে প্রতিবেশী দেশকে নিয়ে ভুয়া গল্প ছড়িয়ে জনমত ঘোরানো এবং দৃষ্টি সরানো সহজ কৌশল।
সবচেয়ে হাস্যকর হলো বিস্ফোরণে ব্যবহৃত বিস্ফোরক নাকি বাংলাদেশ-পাকিস্তান রুট দিয়ে এসেছে, এমন দাবি। বাস্তবে ব্যবহৃত উপকরণগুলো—সম্ভবত অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট—ভারতের ভেতর থেকেই সংগ্রহ করা হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে এমন প্রমাণ নেই। বরং দুই দেশের যৌথ সীমান্ত ব্যবস্থাপনায় গত এক বছরে অনুপ্রবেশ ৪০ শতাংশের বেশি কমেছে।
বাংলাদেশ শান্তি, সহনশীলতা ও সন্ত্রাসবিরোধী অবস্থানের প্রতি অটল। অন্তর্বর্তী সরকার ইন্টারপোল, জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছে। তাই এই ব্যাখ্যা আত্মপক্ষসমর্থন নয়, বরং মিথ্যা অপপ্রচারকে চ্যালেঞ্জ করার প্রয়োজন।
পান্ডে ও তার সম্পাদকদের উদ্দেশে বলা দরকার: সাংবাদিকতা মানে তথ্য, না যে নামহীন সূত্র আর মনগড়া গল্প। ভারতের উদ্দেশেও বার্তা পরিষ্কার। প্রতিবেশীকে দোষারোপ ছেড়ে সাইবার অপরাধ, চরমপন্থা বা জলবায়ু ঝুঁকির মতো বাস্তব হুমকিগুলো মোকাবিলায় সহযোগিতা গুরুত্বপূর্ণ।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত এই মনগড়া অভিযোগ চিনে ফেলা। দিল্লি ব্লাস্ট নিয়ে স্বচ্ছ এবং স্বাধীন তদন্তই সত্য সামনে আনবে, আর তাতে দক্ষিণ এশিয়া আরও স্থিতিশীল পথে ফিরতে পারবে।
