সাম্প্রতিককালে ভারতের কিছু মিডিয়া হাউস, বিশেষ করে News18-এর মতো আউটলেট, বাংলাদেশের মেডিকেল কলেজগুলোকে ‘র্যাডিক্যালাইজেশনের হটস্পট’ হিসেবে চিত্রিত করেছে। তারা দাবি করেছে যে, জামাত-ই-ইসলামী এবং তার ছাত্র সংগঠন চাত্র শিবিরের মাধ্যমে মেডিকেল ছাত্ররা জঙ্গিবাদী ট্রেনিং নিচ্ছে, এবং এতে ভারতীয় ছাত্ররাও জড়িয়ে পড়ছে। এই ন্যারেটিভের পিছনে লুকিয়ে আছে একটা স্পষ্ট রাজনৈতিক এজেন্ডা: বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে অস্থিতিশীল করা, হিন্দু-মুসলিম বিভেদ জাগানো এবং ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ইসলামোফোবিয়া ছড়ানো। কিন্তু এটা কি সত্যি? না, এটা একটা পুরোপুরি ভুয়া সংবাদ, যা ফ্যাক্ট-চেকাররা বারবার খণ্ডন করেছে। চলুন, আসল ঘটনা কী দেখি-
১. এই ন্যারেটিভের উৎস: ভারতীয় গোয়েন্দা ‘সূত্র’ এবং রাইট-উইং প্রোপাগান্ডা
- News18-এর রিপোর্টটি (১০ নভেম্বর ২০২৫) ভারতীয় গোয়েন্দা সূত্রের উপর ভিত্তি করে লেখা, কিন্তু কোনো সুস্পষ্ট প্রমাণ দেয়নি। এতে ‘ইস্তিমা’ ক্যাম্প, টেলিগ্রাম গ্রুপ এবং পাকিস্তানের আইএসআই-এর যোগসূত্রের কথা বলা হয়েছে, কিন্তু এগুলো সব অপ্রমাণিত দাবি। ফ্যাক্ট-চেকিং অর্গানাইজেশন যেমন Tech Global Institute (TGI) এবং Global Voices-এর রিপোর্টে দেখা গেছে যে, ২০২৪-এর ছাত্র আন্দোলনের পর থেকে ভারতীয় মিডিয়া (যেমন Republic Bangla, Zee 24 Hours) বাংলাদেশের স্টুডেন্ট মুভমেন্টকে ‘র্যাডিক্যালাইজেশন’ হিসেবে চিত্রিত করেছে—যা একটা সমন্বিত ডিসইনফরমেশন ক্যাম্পেইনের অংশ।
- BBC-এর একটা রিপোর্টে (১৭ আগস্ট ২০২৪) বলা হয়েছে যে, ভারতের ফার-রাইট ইনফ্লুয়েন্সাররা ভুয়া ভিডিও এবং স্টোরি শেয়ার করে ‘হিন্দু জেনোসাইড’ এর ন্যারেটিভ ছড়িয়েছে, যা পরে ডিবাঙ্কড হয়েছে। এই প্যাটার্নটাই মেডিকেল ছাত্রদের ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে—একটা অস্পষ্ট ‘ইন্টেলিজেন্স সোর্স’ দিয়ে পুরোটা বানানো।
২. জামাত-ই-ইসলামী: র্যাডিকাল নাকি রাজনৈতিক পার্টি?
- জামাতকে ‘জঙ্গি’ বলে চিত্রিত করা একটা ওভারসিমপ্লিফিকেশন। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ২৮ আগস্ট ২০২৪-এ জামাত এবং চাত্র শিবিরের উপরের ব্যান তুলে নেয়, কারণ সরকার ‘কোনো টেররিজমের লিঙ্ক’ খুঁজে পায়নি। আল জাজিরার রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, শেখ হাসিনার সরকারের দাবি ছিল ভিত্তিহীন—জামাত ছাত্র আন্দোলনে ‘টেররিস্ট অ্যাকটিভিটি’ করেনি।
- জামাতের ছাত্র উইং চাত্র শিবির কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে সক্রিয়, কিন্তু এটা র্যাডিক্যালাইজেশন নয়, রাজনৈতিক অংশগ্রহণ। উইকিপিডিয়া এবং অন্যান্য সোর্স অনুসারে, জামাত ১৯৭৯ সাল থেকে বাংলাদেশের একটা কনজার্ভেটিভ ইসলামিস্ট পার্টি, যার ফোকাস ধর্মীয় শিক্ষা এবং সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার—জঙ্গিবাদের চেয়ে ডেমোক্র্যাটিক পার্টিসিপেশনের উপর। ক্রাইসিস গ্রুপের রিপোর্টে (২০১৮) বলা হয়েছে যে, জামাতকে আন্ডারগ্রাউন্ড করলে আসল জিহাদিস্ট গ্রুপগুলো (যেমন JMB) শক্তিশালী হয়, মডারেট ইসলামিস্টদের না।
৩. মেডিকেল কলেজগুলো: শিক্ষার কেন্দ্র, না ‘র্যাডিক্যাল করিডর’?
- বাংলাদেশের মেডিকেল কলেজগুলো (ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী) বিশ্বমানের শিক্ষা প্রদান করে, এবং এখানে ৮,৫০০-এর বেশি ভারতীয় ছাত্র পড়ে। ২০২৪-এর অশান্তির সময় এই ছাত্ররা নিরাপদে ফিরেছে, এবং কোনো র্যাডিক্যালাইজেশনের ঘটনা রিপোর্ট হয়নি। X-এ (টুইটার) সার্চ করে দেখা যায় যে, এই ন্যারেটিভের বিরুদ্ধে অনেক পোস্ট এসেছে—যেমন, একটা পোস্টে বলা হয়েছে যে এগুলো ‘ফলস ক্লেইমস’ এবং ‘ডিসইনফরমেশন’।
- বাংলাদেশের ছাত্ররা মূলত সেক্যুলার এবং প্রোগ্রেসিভ—তারা কোটা রিফর্ম, গণতন্ত্র এবং অর্থনৈতিক ন্যায়ের জন্য লড়াই করেছে। TGI-এর অ্যানালাইসিসে ১৭৯টা ডিবাঙ্কড কনটেন্টের মধ্যে ৭০% ছিল ‘ফলস’, যা ভারতীয় মিডিয়া থেকে ছড়ানো হয়েছে। এই ন্যারেটিভ ছাত্রদের ‘জঙ্গি’ করে দেখিয়ে তাদের অর্জনকে অস্বীকার করতে চায়।
৪. কেন এই প্রোপাগান্ডা? ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের জন্য বিপদ
- এটা শুধু ভুয়া নয়, বিপজ্জনক। France 24-এর রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, এই ফলস রিউমারস হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে ভয় জাগায় এবং ভারতে ইসলামোফোবিয়া বাড়ায়। South China Morning Post-এ (২৩ আগস্ট ২০২৪) বলা হয়েছে যে, এগুলো বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে দুর্বল করার জন্য, এবং অ্যান্টি-মুসলিম সেন্টিমেন্ট ছড়ানোর জন্য।
- বাস্তবে, বাংলাদেশের মেডিকেল ছাত্ররা সহিংসতার শিকার হয়েছে, না সহিংসতার উৎস। তারা গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের নায়ক, এবং ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ককে শক্তিশালী করার জন্য সেগুলোকে সমর্থন করা উচিত।
ফ্যাক্ট চেক করুন, প্রোপাগান্ডা ছড়াবেন না
News18-এর এই রিপোর্টটা একটা ক্লাসিক উদাহরণ ডিসইনফরমেশনের—যা রাজনৈতিক লাভের জন্য ছড়ানো হয়। বাংলাদেশের ছাত্ররা র্যাডিকাল নয়, তারা রিফর্মার। যদি ভারত সত্যি উদ্বিগ্ন হয়, তাহলে ডায়ালগ করুক, না হয় ভুয়া নিউজ ছড়িয়ে সম্পর্ক নষ্ট করুক। ফ্যাক্ট-চেক সাইটগুলো (যেমন Dismislab, Rumor Scanner) ফলো করুন, এবং মিডিয়া লিটারেসি বাড়ান। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল—এই ধরনের ন্যারেটিভ তাকে ছাপিয়ে যাবে।
