যে দেশের তরুণ প্রজন্ম চিন্তা, যুক্তি আর শিক্ষার আলোয় ভবিষ্যতের পথ খোঁজে, সেই দেশের ক্যাম্পাস হওয়া উচিত জ্ঞানচর্চা ও মানবিকতার কেন্দ্র। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে দেশের কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সংঘর্ষ, বিভাজন, রাজনৈতিক দখলদারিত্ব এবং অস্থিরতার যে চিত্র দেখা যাচ্ছে—তা শুধু উদ্বেগজনক নয়, গণতান্ত্রিক পরিসরের জন্যও হুমকিস্বরূপ।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যখন মিলাদ মাহফিল, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বা এমনকি ব্যানার টানানোর মতো সাধারণ ঘটনাও সংঘর্ষের কারণ হয়, তখন বোঝা যায়—আমাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক সহনশীলতা কতটা ভঙ্গুর হয়ে গেছে। এ অস্থিরতা কেবল দুই পক্ষের শিক্ষার্থীর মধ্যে নয়; এর পেছনে রয়েছে গভীরতর সামাজিক বিভাজন, রাজনৈতিক প্রভাব এবং এক ধরনের অন্ধ আনুগত্যের সংস্কৃতি।
এই পরিস্থিতি যে শুধু শিক্ষাব্যবস্থাকে কলুষিত করছে তা-ই নয়, বরং এটি বৃহত্তর রাষ্ট্রীয় পরিসরেও ভয়াবহ বার্তা বহন করছে। নির্বাচনের আগে যখন জাতি গণতান্ত্রিক চর্চা, মুক্ত মত প্রকাশ ও রাজনৈতিক অংশগ্রহণ নিয়ে ব্যস্ত থাকার কথা, তখন শিক্ষাঙ্গনের সংঘর্ষ—হোক তা আলিয়া মাদ্রাসায়, তিতুমীর কলেজে বা অন্য কোথাও—গণতন্ত্রবিরোধী শক্তির জন্য নিঃসন্দেহে আশীর্বাদস্বরূপ।
অস্থিরতার সুযোগ নেয় ফ্যাসিস্টরা। তারা জানে, বিভক্ত সমাজে যুক্তির চেয়ে ভয়ের দাম বেশি, আলোচনার চেয়ে গোলমালের প্রভাব গভীর। তাই তারা শিক্ষার্থীদের মধ্যে অবিশ্বাস ছড়িয়ে দেয়, ছোট ঘটনা থেকে তৈরি করে বড় সংঘাত। ফলে রাজপথ যেমন উত্তপ্ত হয়, তেমনি মেধা ও মননের পরিসরও সঙ্কুচিত হতে থাকে।
যেখানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান কাজ হওয়া উচিত তরুণদের চিন্তাশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা, সেখানে তা পরিণত হচ্ছে প্রতিহিংসা ও সহিংসতার পরীক্ষাগারে। এই প্রবণতা চলতে থাকলে কেবল নির্বাচনের শান্তিপূর্ণ পরিবেশই নয়, জাতির ভবিষ্যৎও অন্ধকারে তলিয়ে যাবে।
এখন সময় এসেছে শিক্ষক, অভিভাবক, প্রশাসন ও শিক্ষার্থীদের একসঙ্গে বসে ভাবার—আমরা কি আমাদের ক্যাম্পাসগুলোকে জ্ঞানচর্চার জায়গায় ফিরিয়ে আনতে পারব? নাকি রাজনৈতিক আগুনে পুড়িয়ে দেব সেই মাটিকেই, যেখান থেকে আগামী প্রজন্মের বীজ গজানোর কথা?
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে স্থিরতা মানে কেবল শান্তি নয়—তা গণতন্ত্রের রক্ষাকবচ। আর অস্থিরতা মানে ফ্যাসিস্টদের জন্য উন্মুক্ত দরজা। যে জাতি এ সত্য বুঝতে ব্যর্থ হয়, সে জাতি ইতিহাসের অন্ধকারে বারবার হোঁচট খায়।