দার্শনিক ফ্রেডরিখ নিৎসে বলেছিলেন কিছু মানুষ সত্য গ্রহণ করতে পারে না, কারণ তারা চায় না তাদের ইল্যুশন শেষ হয়ে যাক। আওয়ামীলীগের অবস্থা হয়েছে এখন এমন। জুলাই গণঅভ্যত্থানের এক বছর পর আওয়ামীলীগ এখনও এটাকে ষড়যন্ত্র বলে প্রচার চালাচ্ছে। অনলাইনে তাদের সরব উপস্থিতি আর প্রোপাগান্ডারগুলোর বড় অংশ জুলাই মাসের আন্দোলনকে কখনো জংগি আন্দোলন, কখনো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ষড়যন্ত্র বলছে। কিন্তু আওয়ামীলীগ সম্ভবত ঘটনার গভীরতা বুঝতে পারছে না।
আপনারা কি জানেন আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে ইজরায়েল থেকে প্রচুর সাহায্য এসেছিল? সেসময়কার ইজরায়েলি সরকার বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক করে সরাসরি সাহায্য করতে চেয়েছিল। প্রবাসী সরকার সে সম্পর্ক এগিয়ে নিতে অস্বীকার করলেও ভারত সরকার সাদরে তা গ্রহণ করেছিল। আবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনেক জায়োনিস্ট রাজনৈতিক, ভারতরে উগ্রপন্থি সংগঠন আরএসএস তখন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করেছিল। ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা র অনেক আগে থেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের একটি অংশের সাথে যোগাযোগ রেখেছিল। তাহলে কি এটা থেকে আমরা কনক্লুসনে আসতে পারি, মুক্তিযুদ্ধ জায়োনিস্ট আর ভারতের ষড়যন্ত্র ছিল? যদি আমরা পাকিস্তারে দৃষ্টিকোণ থেকে দেখি হয়ত এমনই মনে হবে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তানি জান্তার সামরিক আগ্রাসনই তাদের পরাজয় ডেকে এনেছিল। আসলে প্রতিটি রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সাথে অনেক স্টেকহোল্ডার থাকে। এরা যে কোন অস্থিরতায় সুযোগ নিবে এটাই স্বাভাবিক। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছিল যখন পাক হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালীদের উপর অস্ত্র হাতে ঝাপিয়ে পড়েছিল। তারপর যা হয়েছে এসব কিছুই ছিল মূল ঘটনার চেইন রিয়েকশন। সে সময় একটি পর্যায়ে মুক্তিবাহিনী আর ভারতের ইন্টারেস্ট মিলে গিয়েছিল। এই তো কিছুদিন আগে সিরিয়ান বিদ্রোহীরা ইজরায়েলিদের সাথে কো-অর্ডিনেট করে আসাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। আবার এখন ইজরায়েলিদের সাথে তাদের টানাপোড়ন চলছে। যে কোনও বড় ধরনের রাজনৈতিক ঘটনায় অনেক পক্ষ নিজ নিজ ইন্টারেস্টে কাজ করবে এটাই স্বাভাবিক। ২৪’র আন্দোলন ছিল ঠিক একই রকমের ঘটনা। শেখ হাসিনা নিরস্ত্র জনতার উপর গুলি চালিয়েছিলেন এবং এই একটি ঘটনা বাকিসব কিছুর প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে। এটাই সবচেয়ে সরল সত্য। এমনকি যতটা এটাকে মার্কিন ষড়যন্ত্র কিংবা ড. ইউনুসের ষড়যস্ত্র হিসেবে আওয়ামীলীগের পক্ষ থেকে প্রচার করা হয়, মিডিয়া কিংবা কূটনৈতিক মহলে আমেরিকার জড়িত থাকার পক্ষে তেমন কোনও প্রমাণ পাওয়া যায় না। এমনকি জুলাইয়ে ছাত্র হত্যা নিয়ে অফিশিয়ালি আমেরিকা কোন বিবৃতিও দেয়নি।
এবার একটু ভিন্ন প্রেক্ষাপট থেকে দেখা যাক। সাইকোলজিতে রস-কুবলার মডেল নামে একটি মডেল আছে যা শোকের ৫টি স্টেইজকে ব্যাখা করে। এই থিওরি অনুযায়ী মানুষ কোন কিছু হারালে, প্রথমে বিষয়টি গ্রহণ করতে অস্বীকার করে। তারপর রাগ হয়। একটা পর্যায়ে এসে তারা বারগেইন করার চেষ্টা করে। এরপর রিয়েলিটি তাদের আঘাত করলে তারা ডিপ্রেসনে পড়ে যায়। এবং তারপর গ্রহণ করে। শোকের এই সাইকেল ব্যাক্তি বিশেষে একেকভাবে কাজ করে। আওয়ামীলীগের মনস্তত্ব বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে তারা এখন এই মডেলের প্রথম ধাপ ’ডেনায়াল’এ আছে। একদম সর্বোচ্চ লেভেল থেকে নিচু স্তরের কর্মীরাও রিয়েলিটি মানতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে। তাই নানাবিধ ষড়যন্ত্র তত্ব হাজির করছে। কখনো বলছে জুলাই মাসে আমেরিকা গুলি করে মানূষ মেরেছে। আবার কখনো বলছে আন্দোলন করা সমন্বয়করা ৭.৬২ রাইফেল দিয়ে মানুষ মেরেছে। অথচ একটু খোজ করলে দেখা যাবে ৭.৬২ রাইফেল বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনীর ব্যবহার করা সবচেয়ে কমন অস্ত্র। এমনকি সেসময় এটাও জানা যায় গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা সংস্থাগুলো শেখ হাসিনাকে বলপ্রয়োগ না করে ছাত্রদের সাথে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করার পরামর্শ দিয়েছিল। সম্প্রতি আল-জাজিরায় প্রকাশিত একটি তথ্যচিত্রে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সাবেক গোয়েন্দা কর্মকর্তা একই কথা বলেন। কিন্তু শেখ হাসিনা সবার মত উপেক্ষা করে বলপ্রয়োগ করার সিদ্ধান্ত নেন। তাই জুলাই গণঅভ্যত্থান যদি ষড়যন্ত্র হয় তবে এর প্রকৃত মাস্টারমাইন্ড শেখ হাসিনা। আওয়ামীলীগদের যদি এসব প্রমাণ দেখানো হয়, তারা প্রথমে বলে এগুলা এআই, তারপর বলে আমেরিকার ষড়যন্ত্র, আর যখন কিছু বলার থাকে না, তখন বলে এরা জংগি। ঠিক রস-কুবলার মডেলের প্রথম ধাপের মত।
রস-কুবলার মডেলের দ্বিতীয় ধাপ হলো ক্ষোভ। এই মডেল অনুযায়ী আমরা যদি আওয়ামীলীগের পরের পদক্ষেপ বুঝতে চাই তবে দেখবো আওয়ামী লীগ ক্ষোভ প্রকাশের জন্য পরিকল্পনা করছে। সম্প্রতি সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দারা অভিযান চালিয়ে বেশকিছু অস্ত্র উদ্ধার করেছে, যা থেকে আওয়ামীলীগের ভবিষ্যত পরিকল্পনা সম্পর্কে বোঝা যায়। আসলে ৭৫’এর পর একইভাবে আওয়ামীলীগ কিছুদিন দেশের কিছু এলাকায় কাদের সিদ্দীকির নেতৃত্বে যুদ্ধ করেছিল। আওয়ামীলীগ সম্ভবত চায় নির্বাচন বানচাল হোক আর অরাজকতা বিরাজ করুক। সামনের দিনেও জুলাই নিয়ে তাদের প্রোপাগান্ডাগুলো চলতে থাকবে। শুরুতে বলা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে জামাত যেভাবে ভারতের ষড়যন্ত্র বলে প্রচারণা চালায়, আওয়ামীলীগও একইভাবে জুলাইকে মার্কিন-ইউনুসের ষড়যন্ত্র বলে প্রচার করবে। কিছু মানুষ বিশ্বাসও করবে। ঠিক যেমন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে জামাতের বয়ান অনেক তরুণ বিশ্বাস করে বসে। তবে ষড়যন্ত্র তত্ব দিয়ে মূল ধারায় ফিরতে পারবে না।
শেখ হাসিনার পতন কি মার্কিন ষড়যন্ত্র ছিল? আওয়ামী লীগের ভবিষ্যত কী?
66
previous post