ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আইন ‘ফৌজদারি কার্যবিধি’ দ্বিতীয়বারের মতো সংশোধন করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। বিভিন্ন মামলায় উচ্চ আদালতের পর্যবেক্ষণ, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের সুপারিশ এবং অংশীজনদের মতামতের ভিত্তিতে এই সংশোধন করা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের ফৌজদারি বিচারব্যবস্থায় যুগান্তকারী কিছু সংস্কার বাস্তবায়ন করা হয়েছে।
ম্যাজিস্ট্রেটের জরিমানা করার ক্ষমতা বৃদ্ধি
বর্তমানে গ্রাম আদালতের জরিমানা করার ক্ষমতা তিন লাখ টাকা, অথচ প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেটের জরিমানা করার এখতিয়ার মাত্র দশ হাজার টাকা। এবারের সংশোধনীতে ধারায় ম্যাজিস্ট্রেটদের জরিমানা করার এখতিয়ার বৃদ্ধি করা হয়েছে। প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেটের জরিমানা করার ক্ষমতা দশ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে পাঁচ লাখ টাকা, দ্বিতীয় শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষেত্রে পাঁচ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে তিন লাখ টাকা এবং তৃতীয় শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষেত্রে দুই হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে দুই লাখ টাকা করা হয়েছে (ধারা ৩২)।
গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তির রক্ষাকবচ
গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তির সুরক্ষায় ঐতিহাসিক ব্লাস্ট বনাম বাংলাদেশ মামলায় আপিল বিভাগ এবং হাইকোর্ট বিভাগের পর্যবেক্ষণসমূহকে ফৌজদারি কার্যবিধিতে অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে। নতুন ৪৬এ ধারায় বলা হয়েছে, গ্রেপ্তার করার সময় গ্রেপ্তারকারীর নেমপ্লেট থাকতে হবে, নিজের পরিচয় প্রকাশ করতে হবে এবং পরিচয়পত্র দেখাতে হবে। যেক্ষেত্রে আসামিকে তার বাড়ির বাইরে থেকে গ্রেপ্তার করা হয়, সেক্ষেত্রে গ্রেপ্তারের পর অবিলম্বে (যা কোনোভাবেই ১২ ঘণ্টার বেশি হবে না) আসামির পরিবার বা নিকটজনকে জানাতে হবে। গ্রেপ্তারের সময় আসামির শরীরে আঘাতের চিহ্ন থাকলে বা আসামি অসুস্থ হলে অবশ্যই তার প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে এবং আঘাত বা অসুস্থতা সম্পর্কে চিকিৎসকের প্রত্যয়ন গ্রহণ করতে হবে। আসামি যদি আইনজীবীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আগ্রহী হন, সেক্ষেত্রে তাকে সেই সুযোগ দিতে হবে।
মেমোরেন্ডাম অব অ্যারেস্ট
গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তির সুরক্ষায় এবারের সংশোধনীতে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিধান হলো ‘মেমোরেন্ডাম অব অ্যারেস্ট’ এর প্রবর্তন (ধারা ৪৬এ)। আপিল বিভাগের পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে এই বিধান এবং এ-সম্পর্কিত একটি ফর্ম যুক্ত করা হয়েছে। যেকোনো গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রেই পুলিশকে এখন থেকে ‘মেমোরেন্ডাম অব অ্যারেস্ট’ প্রস্তুত করতে হবে। এই ফর্মে গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তির আইনি সুরক্ষাসমূহের একটি চেকলিস্ট রয়েছে। ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে উপস্থাপনের সময় এই ফর্মটিও দাখিল করতে হবে। রক্ষাকবচ সম্পর্কিত বিধানসমূহ কতটা প্রতিপালিত হয়েছে, এই ফর্ম দেখে ম্যাজিস্ট্রেট সেটি তদারকি করতে পারবেন। উল্লেখ্য, আপিল বিভাগের নির্দেশনার আলোকে দেশের কিছু জেলায় বর্তমানে এই ফর্ম সফলভাবে চালু আছে। ফৌজদারি কার্যবিধিতে সন্নিবেশ করার ফলে এখন থেকে সারা দেশে এই বিধান বাস্তবায়িত হবে।
গ্রেপ্তারের তথ্য সরবরাহে বিশেষ বিধান
গ্রেপ্তারকৃতের তথ্য পেতে গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তির পরিবারকে ভয়ানক ভোগান্তিতে পড়তে হয়। গ্রেপ্তারকৃতকে কেন বা কোন মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে, কোথায় রাখা হয়েছে, তার সঙ্গে কীভাবে যোগাযোগ করা যাবে—এ-সম্পর্কিত তথ্যপ্রাপ্তি খুবই কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। নতুন বিধান যুক্ত করে এই সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করা হয়েছে। ৫৪এ ধারায় বলা হয়েছে, গ্রেপ্তারের সময় গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারের কারণ জানাতে হবে। আবার ৪৬বি এবং ৪৬সি ধারায় বলা হয়েছে, প্রতিটি গ্রেপ্তারের তথ্য গ্রেপ্তারকারীর অফিসের রেজিস্টারে অন্তর্ভুক্ত করার পাশাপাশি যে থানা এলাকা থেকে আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, সেই থানার সাধারণ ডায়েরিতেও এন্ট্রি করতে হবে। গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তির পক্ষে কেউ থানায় যোগাযোগ করলে তাকে গ্রেপ্তার সম্পর্কিত প্রয়োজনীয় তথ্য অবশ্যই সরবরাহ করতে হবে। একই সঙ্গে প্রতি থানা, জেলা ও মহানগর পুলিশ অফিসে প্রতিদিন গ্রেপ্তারের তালিকা প্রকাশ করতে হবে।
গ্রেপ্তারকৃতের টাকা-পয়সা ও মূল্যবান সামগ্রীর তালিকা
গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তির কাছে অনেক সময় টাকা-পয়সা, অলঙ্কার, মোবাইল ফোন ইত্যাদি মূল্যবান সামগ্রী থাকে। এসব দ্রব্য যদি অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়, সেক্ষেত্রে মামলার জব্দতালিকায় সেগুলো উল্লেখ করা হয়। কিন্তু অনেক সময় এসব মূল্যবান বস্তুর সঙ্গে অপরাধের সংযোগ থাকে না। সেক্ষেত্রে এসব সামগ্রী নিয়ে নয়ছয়ের অভিযোগ পাওয়া যায়। এখন থেকে গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তির কাছে এমন মূল্যবান সামগ্রী পাওয়া গেলে তার জন্য পৃথক তালিকা প্রস্তুত করতে হবে এবং সম্ভব হলে সেই তালিকায় একজন সাক্ষীর স্বাক্ষর গ্রহণ করতে হবে। ওই তালিকার একটি কপি গ্রেপ্তারকৃতের নিকটজনকে দিতে হবে। (ধারা ৫১)।
৫৪ ধারায় গ্রেপ্তারে অধিকতর সতর্কতা
অনেকের ধারণা, ৫৪ ধারার গ্রেপ্তার মানে সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ ছাড়াই খামখেয়ালী গ্রেপ্তার। মনে করা হয়, মামলাসূত্রে যেসব গ্রেপ্তার, সেগুলো ৫৪ ধারার অধীন নয়। অথচ বাস্তবতা হলো, পুলিশ যেসব ক্ষেত্রে আদালতের পরোয়ানা ছাড়া গ্রেপ্তার করতে পারে, ৫৪ ধারায় তার একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা রয়েছে। থানায় দায়েরকৃত এজাহার কিংবা আদালত দায়েরকৃত নালিশি মামলা- তদন্ত যদি পুলিশ কর্তৃক পরিচালিত হয়, আর পুলিশ যদি আমলযোগ্য (কগনিজেবল) অপরাধের বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ পায়, সেক্ষেত্রে আসামিকে ওই মামলাসূত্রে পুলিশের গ্রেপ্তার করার যে ক্ষমতা, সেটিও ৫৪ ধারার বিষয়বস্তু।
এবারের সংশোধনীতে আমলযোগ্য অপরাধ সম্পর্কিত পুলিশের গ্রেপ্তারের এই ক্ষমতা আরও সুনির্দিষ্ট ও জবাবদিহিমূলক করার চেষ্টা করা হয়েছে। আমলযোগ্য অপরাধে কাউকে বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার করতে হলে পুলিশকে দেখাতে হবে, পুলিশের সামনে ওই ব্যক্তি অপরাধটি ঘটিয়েছেন। অন্যদিকে, আমলযোগ্য অপরাধ সংক্রান্ত কোনো এজাহার বা নালিশি মামলা পুলিশের কাছে তদন্তাধীন থাকলে এবং পুলিশ ওই মামলা সংক্রান্তে কাউকে গ্রেপ্তার করতে চাইলে পুলিশকে দেখাতে হবে, অপরাধটি ওই ব্যক্তি করেছেন মর্মে পুলিশের সন্দেহ করার যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে। যেখানে আমলযোগ্য অপরাধটির সাজা সাত বছর বা তার কম, সেক্ষেত্রে পুলিশকে আরও দেখাতে হবে যে, আসামি অধিকতর অপরাধ জড়ানো থেকে প্রতিহত করতে, তার পালিয়ে যাওয়ার ঠেকাতে বা সাক্ষ্যপ্রমাণ লোপাট করা থেকে তাকে বিরত রাখতে এই গ্রেপ্তার জরুরি।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন হলো, আমলযোগ্য অপরাধের ক্ষেত্রে আসামিকে গ্রেপ্তার করা কিংবা না করা উভয় ক্ষেত্রেই পুলিশকে এর কারণ ব্যাখ্যা করতে হবে। একই সঙ্গে কোনো ব্যক্তিকে নিবারণমূলক আটক করার প্রয়োজনে ৫৪ ধারার বিধান প্রয়োগ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
গ্রেপ্তার সম্পর্কিত বিধানের প্রতিপালনে আদালতের দায়িত্ব
গ্রেপ্তার সম্পর্কিত যেসব বিধান আইনে আছে, সেগুলো সঠিকভাবে প্রতিপালিত হচ্ছে কিনা, তা দেখভালের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ম্যাজিস্ট্রেট বা আদালতকে। ৬৭এ ধারায় বলা হয়েছে, যে ম্যাজিস্ট্রেট বা আদালতের সামনে গ্রেপ্তারকৃত আসামি হাজির করা হবে, তার দায়িত্ব হবে গ্রেপ্তার সম্পর্কিত বিধানাবলি প্রতিপালন হয়েছে কিনা দেখা। কোনো ব্যত্যয় পাওয়া গেলে আদালত অবহেলাকারী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে চাকরিবিধি অনুসারে ব্যবস্থা গ্রহণের আদেশ দিতে পারবে।
পুলিশ রিমান্ড ও শ্যোন অ্যারেস্ট
একজন আসামিকে কতদিন পর্যন্ত পুলিশ রিমান্ডে রাখা যায়, সে ব্যাপারে ফৌজদারি কার্যবিধির বিদ্যমান বিধান অস্পষ্ট। এবার ১৬৭ ধারায় সংশোধন করে বলা হয়েছে, এক মামলায় কোনোভাবেই ১৫ দিনের বেশি পুলিশ রিমান্ড নয়। একই সঙ্গে রিমান্ডে প্রেরণের আগে-পরেও আসামির স্বাস্থ্য পরীক্ষার বিধান যুক্ত করা হয়েছে। রিমান্ডে নির্যাতন করলে এবং আসামির শরীরে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেলে ম্যাজিস্ট্রেট আইন অনুসারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন এমন বিধান যুক্ত করা হয়েছে।
আবার ‘শ্যোন অ্যারেস্ট’ সম্পর্কিত ১৬৭এ ধারায় যুক্ত করা হয়েছে, এক মামলার আসামিকে অন্য মামলায় গ্রেপ্তার দেখাতে চাইলে পুলিশকে আদালতে আসামি ও পুলিশ ডায়েরি উপস্থাপন করতে হবে এবং আসামিকে শুনানির সুযোগ দিতে হবে।
তদন্তের সময়সীমা নির্ধারণ
ফৌজদারি কার্যবিধিতে প্রথমবারের মতো তদন্তের সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। ১৭৩বি ধারায় বলা হয়েছে, এখন থেকে যেকোনো মামলার তদন্ত সাধারণভাবে ৬০ কর্মদিবসের মধ্যে সম্পন্ন করতে হবে। এই সময়সীমার মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা সম্ভব না হলে বিস্তারিত কারণ এবং প্রয়োজনীয় অতিরিক্ত সময় প্রার্থনা করে তদন্তকারী প্রতিবেদন প্রেরণ করবেন। তার প্রেক্ষিতে ম্যাজিস্ট্রেট তদন্তের সময়সীমা বর্ধিত করতে পারবেন। বর্ধিত সময়ের মধ্যেও তদন্ত সম্পন্ন না হলে তদন্তকারী পুনরায় তার কারণ ব্যাখা করে ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট প্রতিবেদন পেশ করবেন। তদন্তকারীর গাফলতি প্রতীয়মান হলে ম্যাজিস্ট্রেট প্রয়োজন মনে করলে তদন্তকারী পরিবর্তন বা তদন্তকারীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করতে পারবে।
সংক্ষিপ্ত বিচারে বিশেষ বিধান
সংক্ষিপ্ত বিচারের ক্ষেত্রে ম্যাজিস্ট্রেটের আর্থিক এখতিয়ার বাড়ানো হয়েছে। পূর্বে চুরি, আত্মসাৎ প্রভৃতি মামলার বিষয়বস্তুর মূল্যমান অনূর্ধ্ব দশ হাজার টাকা হলে তার বিচার সংক্ষিপ্ত পদ্ধতিতে করা সম্ভব ছিল। বর্তমানে এই মূল্যমান বাড়িয়ে পাঁচ লাখ টাকা করা হয়েছে। সংক্ষিপ্ত বিচার সংক্রান্ত বিশেষ বিধান ২৬৪এ যুক্ত করে বলা হয়েছে, সম্ভব হলে একই বৈঠকে আসামির বিরুদ্ধে চার্জ গঠন থেকে শুরু করে যাবতীয় কার্যক্রম সম্পন্ন করা যাবে এবং যেকোনো স্থানে সংক্ষিপ্ত বিচার আদালত পরিচালনা করা যাবে।
অনুপস্থিত আসামির বিচারে ক্রোকি ও হুলিয়া পরোয়ানা বাধ্যতামূলক নয়
অনুপস্থিত আসামির বিচারে ক্রোকি ও হুলিয়া পরোয়ানা কেবল দীর্ঘসূত্রতা সৃষ্টিকারী এক প্রক্রিয়ার নাম। ৩৩৯বি ধারা সংশোধন করে বলা হয়েছে, আসামির অনুপস্থিতিতে বিচার করার জন্য ক্রোকি ও হুলিয়া পরোয়ানা জারির কোনো আবশ্যকতা আর থাকবে না। ফলে পলাতক আসামির মামলা দ্রুততর সময়ের মধ্যে বিচারের জন্য প্রস্তুত হবে।
একইসঙ্গে পলাতক আসামিকে আদালেত উপস্থিত হওয়ার আদেশ দুটি পত্রিকার পরিবর্তে একটি বাংলা পত্রিকায় এবং পাশাপাশি ওয়েবসাইটে প্রকাশ করার বিধান সন্নিবেশ করা হয়েছে।
আপসযোগ্য মামলা
বেআইনি সমাবেশ সম্পর্কিত দণ্ডবিধির ১৪৩ ধারা এতদিন আপসঅযোগ্য ছিল। এবার এই অপরাধকে আপসযোগ্য করা হয়েছে। এতদিন অনেক মামলা আপসে নিষ্পত্তি করার পথে এই ধারাটির আপসঅযোগ্যতা বাধা ছিল।
আপসের ক্ষেত্রে আরও একটি বড় সংশোধনী হলো— এখন থেকে আদালত নিজে আপস কার্যক্রমে সহযোগিতা করতে পারবে এবং পাশাপাশি জেলা লিগ্যাল এইড অফিস আপসের জন্য মামলা প্রেরণ করতে পারবে। শুধু তাই নয়, আপসের ভিত্তিতে কোনো চুক্তি সম্পাদিত হলে সেই চুক্তি নথিভুক্ত করে এর শর্ত বাস্তবায়নে আদালত প্রয়োজনীয় ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবে। অনেক মামলায় দেখা যায়, আপস হলেও আপসের চুক্তি লিপিবদ্ধ করা হয় না এবং আসামি চুক্তি মোতাবেক কিস্তিতে কিছু টাকা পরিশোধের পর টাকা প্রদান বন্ধ করে দেন। এরকম ক্ষেত্রে এতদিন আপস-প্রক্রিয়া স্থগিত করে সাক্ষ্যগ্রহণের মাধ্যমে মামলার রায় দিতে হতো। এখন থেকে আপস-চুক্তি থাকলে আদালত সাক্ষ্যগ্রহণের দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় না গিয়েও চুক্তি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে পারবে।
জামিনে শর্তযুক্ত করা
বর্তমানে প্রবেশন ব্যবস্থার মাধ্যমে সাজাপ্রাপ্ত আসামির ওপর নানা শর্ত আরোপ করার সুযোগ রয়েছে। এভাবেই সারা দেশে হাজার হাজার আসামি সংশোধন হচ্ছে। তবে প্রবেশনের সীমাবদ্ধতা হলো এটি কেবল মামলার শেষে প্রয়োগযোগ্য। মামলা চলাকালে আসামির সদাচরণ সংক্রান্ত শর্ত আরোপ করার সুযোগ আছে কি না, তা নিয়ে আদালত অঙ্গনে দ্বিধা ছিল। অনেক মনে করেন, শর্ত আরোপ করে জামিন প্রদানের সুযোগ নেই। তবে এ-সম্পর্কিত বিভিন্ন রেফারেন্স পাঠ করলে দেখা যায়, কেবল এমন কঠোর শর্ত দেওয়া যাবে না, যা জামিন না দেওয়ারই নামান্তর। যেমন আসামির সামর্থ্যবহির্ভুত বিরাট অঙ্কের টাকা জমাদান সাপেক্ষে জামিন দেয়া হলে সেই শর্ত সঠিক হবে না। এরকম শর্তের বাইরে আসামির সদাচরণ নিশ্চিত করার জন্য যুক্তিসঙ্গত শর্ত আরোপ করার সুযোগ উচ্চ আদালতের বহু সিদ্ধান্তে প্রতিফলিত হয়েছে। এবারের সংশোধনীতে ৪৯৮ ধারায় বলা হয়েছে, জামিন প্রদানের সময় আদালত যুক্তিসঙ্গত ও ন্যায্য যেকোনো শর্ত আরোপ করতে পারবে। ফলে মামলা চলাকালে আসামিদের ডোপটেস্ট বা সমাজকল্যাণমূলক কাজে অংশগ্রহণের শর্ত আরোপ করতে পারবে আদালত। যা সংশোধনমূলক বিচার প্রক্রিয়ার জন্য দারুণ সহায়ক হবে।
ব্যক্তিগত হাজিরা থেকে আসামির অব্যাহতি
ফৌজদারি মামলায় ভোগান্তির জন্য আসামিকে চূড়ান্ত রায় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় না। মামলা রুজু হওয়ার পর থেকেই এই হয়রানি শুরু হয় মূলত তারিখে তারিখে আদালতে হাজিরা দেওয়ার মাধ্যমে। জামিনপ্রাপ্ত আসামিরও নিস্তার নেই এই ব্যক্তিগত হাজিরা থেকে। হাজিরা দিতে একটু ব্যত্যয় ঘটলেই আসামির বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট জারি হয়। এবারের সংশোধনীতে তদন্ত চলাকালে আসামির হাজিরা শিথিল করার চেষ্টা করা হয়েছে। ৫৪০এ ধারায় বলা হয়েছে, আদালত চাইলে তদন্ত রিপোর্ট শুনানি পর্যন্ত জামিনপ্রাপ্ত আসামিকে ব্যক্তিগত হাজিরা থেকে অব্যাহতি দিতে পারবে। এ-সময় আসামি তার আইনজীবীর মাধ্যমে হাজিরা দিতে পারবেন। পূর্বে কোনো কোনো আদালত ২০৫ ধারার অধীনে এ ধরনের প্রতিকার প্রদান করতেন, যদিও আইনত ওই ধারা কেবল মামলা আমলে গ্রহণের পর প্রযোজ্য, তার আগে প্রযোজ্য নয়। নতুন আইনে স্পষ্ট বিধান যুক্ত হওয়ায় সারা দেশের লাখ লাখ জামিনপ্রাপ্ত আসামি ব্যক্তিগত হাজিরার ভোগান্তি থেকে মুক্তি পাবেন।
একই সঙ্গে মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ চলাকালে কোনো আসামি উপস্থিত না থাকলেও এখন থেকে আসামির আইনজীবী আদালতের অনুমতিক্রমে সাক্ষীদের জেরা করতে পারবেন। এতদিন পর্যন্ত এই সুযোগ নিতে হলে অন্তত একজন আসামি আদালতে উপস্থিত থাকতে হতো।
সাক্ষীর খরচ ও সুরক্ষা
আদালতে আগত সাক্ষীদের অনেকেই দিনমজুর শ্রেণির মানুষ। সাক্ষ্যদানের পর তারা যাতায়াত ও খোরাকি ভাতা প্রত্যাশা করেন। ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪৪ ধারায় সাক্ষীর খরচ প্রদানের জন্য বিধান থাকলেও সেটি কার্যকর করার জন্য পৃথক বিধি প্রণয়ন করার বাধ্যবাধকতা ছিল। বিষয়টি সহজ করার উদ্দেশ্যে এবার ‘বিধি’-এর পরিবর্তে ‘সরকারি আদেশ’ দ্বারা প্রয়োজনীয় বিধান করার সুযোগ রাখা হয়েছে।
অন্যদিকে সাক্ষী সুরক্ষায় বিভিন্ন বিশেষ আইনে বিধান থাকলেও ফৌজদারি কার্যবিধিতে কোনো বিধান ছিল না। এবারের সংশোধনীতে সাক্ষী ও ভিকটিমদের সুরক্ষায় প্রয়োজনীয় যেকোনো আদেশ প্রদানের ক্ষমতা আদালতকে দেওয়া হয়েছে। ফলে সব ধরনের ফৌজদারি মামলায় সাক্ষীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার পথ সুগম হয়েছে।
দণ্ডবিধির ৩২৫ ধারা জামিনঅযোগ্য
দণ্ডবিধির ৩২৫ ধারা এতদিন পর্যন্ত জামিনযোগ্য ছিল। ফলে হাত-পা ভেঙে যাওয়া, চোখ-কানের মতো মূল্যবান অঙ্গহানির ক্ষেত্রেও আসামি জামিনে মুক্ত হওয়ার সুযোগ পেত। আসামির জামিনকে কঠিন করার জন্য মামলায় ভয়ঙ্কর অস্ত্রের মিথ্যা বর্ণনা যুক্ত করা হতো, যাতে মামলাটি দণ্ডবিধির জামিনঅযোগ্য ৩২৬ ধারার আওতায় দেখানো যায়। এতে করে মামলার প্রাথমিক পর্যায়ে জামিন কঠিন হলেও চূড়ান্ত সাক্ষ্যপ্রমাণে ভয়ঙ্কর অস্ত্রের প্রমাণ না মিললে আসামি সুবিধা পেত। সবদিক বিবেচনায় এবারের সংশোধনীতে দণ্ডবিধির ৩২৫ ধারাকে জামিনঅযোগ্য করা হয়েছে। ফলে গুরুতর জখমের ক্ষেত্রে অস্ত্রের প্রয়োগ ছিল কি না, জামিন প্রদানের ক্ষেত্রে এখন থেকে আর সেটি ধর্তব্য হবে না।
মিথ্যা মামলার সাজা বৃদ্ধি
ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে কোনো মামলা মিথ্যা প্রমাণিত হলে মামলাকারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ পূর্বে ঐচ্ছিক ছিল (২৫০ ধারা)। বর্তমানে এটিকে ম্যাজিস্ট্রেটের বাধ্যতামূলক দায়িত্ব করা হয়েছে। একই সঙ্গে মিথ্যা মামলার সর্বোচ্চ অর্থদণ্ড তিন হাজার থেকে বাড়িয়ে এক লাখ টাকায় উন্নীত করা হয়েছে। ক্ষতিপূরণের পরিমাণ এক হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে পঞ্চাশ হাজার টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়েছে।
বিবিধ
ডিজিটাল মাধ্যমে সমন জারি এবং অনলাইনে বেল বন্ড দাখিল করার সুযোগ রাখা হয়েছে। বেত্রাঘাতের মতো অবমাননাকর সাজা সম্পর্কিত সকল বিধান বিলুপ্ত করা হয়েছে। পূর্বে আপিলঅযোগ্য অর্থদণ্ডের পরিমাণ ছিল পঞ্চাশ টাকা, এটিকে বাড়িয়ে পাঁচ হাজার টাকা করা হয়েছে।
….
Maruf Allam
Ministry of Law & Parliamentary Affairs.