বাংলাদেশে শিল্পের সম্ভাবনা নতুন কিছু নয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, আমরা সেই সম্ভাবনাকে কতটা কাজে লাগাতে পারছি। বড় সেতু, মেট্রোরেল বা মেগা প্রজেক্ট চোখে পড়ার মতো উন্নয়ন। তবে একটি দেশের অর্থনৈতিক ভিত আসলে শক্ত হয় শিল্পায়নের মাধ্যমে। ভিয়েতনাম, দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশগুলো প্রথমে শিল্প গড়ে তুলেছে, পরে এসেছে বড় অবকাঠামো। বাংলাদেশে সেই ধারাবাহিকতা এখনো পুরোপুরি তৈরি হয়নি।
এর বড় কারণ জায়গা ও অবকাঠামোর সংকট। ঘনবসতিপূর্ণ দেশে নতুন করে শিল্পের জন্য জমি বের করা কঠিন। বিদ্যুৎ, গ্যাস, সড়ক সংযোগের মতো মৌলিক সুবিধা দিতেও সময় ও অর্থ লাগে। এই বাস্তবতায় একটি কার্যকর সমাধান হতে পারে দেশের অব্যবহৃত বা বন্ধ শিল্পাঞ্চলগুলোকে নতুনভাবে কাজে লাগানো।
এই ধারণা থেকেই একটি প্রকল্প নিয়ে কাজ করছে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা)। অনুপ্রেরণা এসেছে চীনসহ বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতা থেকে। চীনের শেনজেন একসময় ছিল সাধারণ কৃষি ও মৎস্যনির্ভর এলাকা। ১৯৭৯ সালে এটিকে স্পেশাল ইকোনমিক জোন ঘোষণা করার পর অব্যবহৃত জমিতে দ্রুত শিল্প অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়। বিদেশি বিনিয়োগ আসে, কর্মসংস্থান বাড়ে, আর কয়েক দশকের মধ্যেই শেনজেন হয়ে ওঠে চীনা অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি।
শুধু চীন নয়। জার্মানির Ruhr অঞ্চল, যেখানে একসময় কয়লা ও ইস্পাত শিল্পের আধিপত্য ছিল, আজ সেখানে পরিত্যক্ত খনি ও কারখানা রূপ নিয়েছে প্রযুক্তি কেন্দ্র, থিম পার্ক ও ল্যান্ডস্কেপ পার্কে। যুক্তরাষ্ট্রের বস্টন নেভি ইয়ার্ড বন্ধ সামরিক স্থাপনা থেকে আধুনিক অফিস, গবেষণা কেন্দ্র ও আবাসিক এলাকায় পরিণত হয়ে আবার শহরের অর্থনীতিতে অবদান রাখছে।
বাংলাদেশেও এমন একটি সুযোগ রয়েছে ঢাকার ডেমরায় অবস্থিত করিম জুট মিলকে ঘিরে। শীতলক্ষা নদীর তীরে অবস্থিত এই মিলটি সুলতানা কামাল সেতুর কারণে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটের সঙ্গে সহজ যোগাযোগ সুবিধা দেয়। নদীপথে পরিবহনের জন্য জেটি স্থাপনের সুযোগ থাকায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যও সহজ করা সম্ভব।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এখানে আগে থেকেই বিদ্যুৎ সাব-স্টেশন, গ্যাস সংযোগসহ প্রয়োজনীয় ইউটিলিটি রয়েছে। ফলে শূন্য থেকে অবকাঠামো তৈরি না করে একটি ‘রেডিমেড প্ল্যাটফর্ম’ ব্যবহার করা যাবে। বেজার মতে, এটি শেনজেন মডেলের মতো দ্রুত শিল্পায়নের জন্য বড় সুবিধা।
প্রায় ৪৯.৬৩ একর জমির এই প্রকল্পে ১,০৭,০৮১ বর্গমিটার এলাকা সরাসরি শিল্প উৎপাদনের কাজে ব্যবহার করা যাবে। মিল ও গোডাউন এলাকার ৩৬,১৩৬.৬২ বর্গমিটার স্থাপনা সংস্কার করে দ্রুত ভাড়ার উপযোগী কারখানা ভবন হিসেবে বিনিয়োগকারীদের দেওয়া সম্ভব হবে। এতে সময় ও নির্মাণ ব্যয় দুটোই কমবে।
প্রকল্পটির সম্ভাব্য বিনিয়োগ ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ২০০ কোটি টাকা। বিপরীতে বাৎসরিক আয় হতে পারে প্রায় ১৮.৫২ কোটি টাকা। তবে এর প্রকৃত মূল্য শুধু আয়ের অঙ্কে সীমাবদ্ধ নয়।
এই অর্থনৈতিক অঞ্চলে প্রত্যক্ষভাবে প্রায় ২৫ হাজার এবং পরোক্ষভাবে প্রায় ৪০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা রয়েছে। এতে স্থানীয় অর্থনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে। এখানে তৈরি পোশাক শিল্পের পাশাপাশি ফেব্রিক্স, জিপার, বাটন, সুতা, লেবেল এবং হালকা ইলেকট্রনিক অ্যাসেম্বলিং শিল্পকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। এতে রপ্তানি পণ্যের বৈচিত্র্য বাড়বে এবং সেকেন্ডারি র’ ম্যাটেরিয়াল শিল্পের বিকাশ ঘটবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এ ধরনের প্রকল্প সফল হলে আগামী কয়েক দশকে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রকৃত বৈচিত্র্য আসতে পারে। অব্যবহৃত শিল্পাঞ্চলকে নতুন করে কাজে লাগানো গেলে শিল্পায়নের গতি বাড়বে, কর্মসংস্থান তৈরি হবে এবং দেশের অর্থনীতি পাবে আরও শক্ত ও টেকসই ভিত্তি।
