বাংলাদেশের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই মূলত রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা ও কৌশলগত স্বার্থ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। তবে বিভিন্ন সময়ে তাদের কিছু কর্মকাণ্ড বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। বিশেষ করে জোরপূর্বক গুম, রাজনৈতিক পর্যবেক্ষণ, মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ বা অতিরিক্ত ক্ষমতার প্রয়োগের কারণে এ বিতর্ক দানা বেঁধেছে। সাম্প্রতিক সময়ে ট্রাইবুনালে কিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপিত হওয়ার পর এ দাবি আরও জোরালো হয়েছে। তবে সংস্থাটি বিলুপ্ত করা কোনো যুক্তিসঙ্গত সমাধান নয়। বরং এটিকে সংস্কার করে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারমুক্ত ও জবাবদিহিমূলক কাঠামোর আওতায় আনা ও পেশাগতভাবে আরও দক্ষ করা জাতীয় নিরাপত্তার জন্য অপরিহার্য।
বিভিন্ন সময়ে দেশের পুলিশ বাহিনীকে কেন্দ্র করে দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ নতুন নয়। তবে এসব সমস্যার সমাধান সংস্থাটি বিলুপ্ত করা নয়, বরং এর কাঠামোগত সংস্কার ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা জরুরি। সেই লক্ষ্যেই বর্তমান সরকার পরিচালিত হচ্ছে। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা ও অপরাধ দমন ইত্যাদি সবকিছুতেই পুলিশের ভূমিকা অপরিহার্য। তাছাড়া বাস্তবে আমলা, পুলিশ ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব সব ক্ষেত্রেই দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ পাওয়া যায়। তাই কোনো একক প্রতিষ্ঠানকে দায়ী করে সেটিকে বিলীন করা সমাধান নয়। কিছু সংখ্যক উচ্চাভিলাষী বা বিপথগামী কর্মকর্তার কারণে পুরো সংস্থার অর্জন ও প্রয়োজনীয়তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা সমীচীন নয়। বরং প্রয়োজন হলো পেশাদারিত্ব, প্রশিক্ষণ, নৈতিকতা ও জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থা জোরদার করা।
কারণ, ডিজিএফআই দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার অংশ হিসেবে সামরিক ও কৌশলগত তথ্য সংগ্রহ করে। বিশেষ করে অভ্যন্তরীণ ও বহিরাগত হুমকি, যেমন সন্ত্রাসবাদ, গোপন নাশকতা, সীমান্ত নিরাপত্তা বা বিদেশি গোয়েন্দা কার্যক্রম ইত্যাদি প্রতিরোধে এই সংস্থার ভূমিকা অপরিহার্য। এটি না থাকলে জাতীয় নিরাপত্তার একটি বড় ফাঁক সৃষ্টি হবে তাতে সন্দেহ নেই। তাছাড়া আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা সহযোগিতার ক্ষেত্রে সংস্থাটির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। বৈশ্বিক সন্ত্রাস দমন, মানবপাচার, সাইবার হুমকি ও সীমান্ত অপরাধ মোকাবিলায় বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সঙ্গে তথ্য বিনিময় করে আঞ্চলিক নিরাপত্তা রক্ষায় কাজ করছে সংস্থাটি। বিলুপ্ত হওয়ার অর্থই হচ্ছে এসব আন্তর্জাতিক সহযোগিতা থেকে বাংলাদেশ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো, যেকোনো সামরিক অভিযানের আগে গোয়েন্দা তথ্য ছাড়া কার্যকর পরিকল্পনা সম্ভব নয়। তাই সেনাবাহিনীর অধীনে পরিচালিত হওয়ায় এক্ষেত্রে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম।
বিলীন না করার পেছনে যুক্তি:
১. লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, বর্তমানে ডিজিএফআইয়ে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ নেই; ফলে গত এক বছরে সংস্থাটির বিরুদ্ধে কোনো উল্লেখযোগ্য অভিযোগ ওঠেনি, যা এর পেশাদারিত্ব ও নিরপেক্ষতা বৃদ্ধির প্রমাণ। অর্থাৎ, মুল কারণ ছিল রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার। ফ্যাঁসিবাদ আমলে বিভিন্ন উপায়ে সংস্থাটিকে ব্যবহার করা হয়েছে। তবে জুলাই আন্দোলনের পর গুম, হত্যা ইত্যাদির কোনো অভিযোগ আসেনি। তাই রাজনৈতিক হস্তক্ষেপমুক্ত করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।
২. ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সেভেন সিস্টার্স ও বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল ভৌগোলিকভাবে সংবেদনশীল ও নিরাপত্তা ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা। এসব সীমান্ত ঘেঁষা অঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন, অস্ত্র ও মাদক পাচার, অবৈধ অনুপ্রবেশ এবং সীমান্ত সংঘাতের মতো চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান। এই প্রেক্ষাপটে ডিজিএফআই সবচেয়ে কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে পারে। সংস্থাটি সীমান্তবর্তী এলাকায় গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ, সন্ত্রাসী নেটওয়ার্ক শনাক্তকরণ, বিদেশি গোয়েন্দা কার্যক্রম প্রতিরোধ এবং পার্বত্য অঞ্চলে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে কাজ করে। পাশাপাশি, সেভেন সিস্টার্স অঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সম্ভাব্য যোগাযোগ ও তাদের প্রভাব বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়া রোধেও ডিজিএফআই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সুতরাং, রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও সীমান্ত নিরাপত্তা রক্ষায় এই দুটি অঞ্চলে ডিজিএফআইয়ের সক্রিয় উপস্থিতি অপরিহার্য।
৩. আবার, ভারত ও মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে প্রায়শই অবৈধ অনুপ্রবেশ বা জোরপূর্বক “পুশ ইন” ঘটনার আশঙ্কা থাকে। এসব ক্ষেত্রে ডিজিএফআইয়ের উপস্থিতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ সংস্থাটি সীমান্তবর্তী এলাকায় গোয়েন্দা নজরদারি, অনুপ্রবেশের আগাম তথ্য সংগ্রহ ও সামরিক-বেসামরিক সমন্বয়ের মাধ্যমে তা প্রতিরোধে ভূমিকা রাখে।
৪. বিশেষত, রোহিঙ্গা সংকটের পর মিয়ানমার সীমান্তে নতুন অনুপ্রবেশ ঠেকানো এবং ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল থেকে অবৈধ অভিবাসন রোধে ডিজিএফআই সীমান্ত গোয়েন্দা তৎপরতা ও কূটনৈতিক পর্যায়ে তথ্য সরবরাহের মাধ্যমে কার্যকর সহায়তা দেয়। জাতীয় নিরাপত্তা ও সীমান্ত নিয়ন্ত্রণে জোরপূর্বক পুশ ইন প্রতিরোধে ডিজিএফআই অপরিহার্য একটি সংস্থা। ডিজিএফআইয়ের উপস্থিতি না থাকার অর্থই হলো এই অঞ্চলগুলোকে ঝুঁকিতে ফেলা।
বলা বাহুল্য, একটি আধুনিক রাষ্ট্রের নিরাপত্তা কাঠামোতে বেসামরিক ও সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা উভয়ই প্রয়োজন। বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান ও আঞ্চলিক চ্যালেঞ্জের কারণে এমন একটি শক্তিশালী সংস্থার প্রয়োজন রয়েছে। ডিজিএফআইকে ঘিরে বর্তমানে যেসব বিতর্ক তৈরি হয়েছে, সেগুলোর মূল কারণ জবাবদিহিতার ঘাটতি ও রাজনৈতিক প্রভাব। তাই সংস্থাটিকে বিলুপ্ত না করে আইনগত কাঠামোর মাধ্যমে এর কর্মকাণ্ডকে স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক করা উচিত। সংসদীয় পর্যবেক্ষণ, মানবাধিকার প্রশিক্ষণ এবং নাগরিক অধিকার সংবেদনশীলতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। যেসকল কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠছে, তাদেরকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। তবে, বিপথগামী কিছু অফিসারের জন্য পুরো সংস্থাকে বিলুপ্ত করা সমীচীন হবে না। কারণ, আবশ্যকভাবে জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে ডিজিএফআই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। ডিজিএফআই বিলুপ্ত করা মানে জাতীয় নিরাপত্তার একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ ধ্বংস করা। এর পরিবর্তে প্রয়োজন প্রতিষ্ঠানটিকে সংস্কার, পেশাদারিত্ব বৃদ্ধি, নাগরিক অধিকার ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা। এর কার্যক্রমকে সংবিধান ও মানবাধিকারের সীমার মধ্যে নিয়ে আসতে হবে।