খাগড়াছড়ি জেলার লক্ষ্মীছড়ি উপজেলার দুর্গম এলাকা বড়মাছড়ি।
চট্টগ্রাম, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ির ত্রিমোহনায় অবস্থিত এই অঞ্চল বহুদিন ধরেই পার্বত্য সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে পরিচিত।
বিগত দুই দশক ধরে এখানে ইউপিডিএফ (United People’s Democratic Front) সশস্ত্র কার্যক্রম, চাঁদাবাজি, অপহরণ, ও অস্ত্র পাচারের কেন্দ্র গড়ে তুলেছে।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দীর্ঘদিন পর্যবেক্ষণের পর সাম্প্রতিক সময়ে এই এলাকায় একটি *TOB (Temporary Operating Base)* স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে — মূলতঃ আইনশৃঙ্খলা ও জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে।
কিন্তু এই যৌক্তিক সিদ্ধান্তের বিরোধিতায় মাঠে নেমেছে ইউপিডিএফ। তারা স্থানীয় জনগণকে বিভ্রান্ত করে, ধর্মীয় আবেগকে উসকে দিয়ে এবং ভুয়া জমির দাবির আড়ালে সেনাবাহিনীর উপস্থিতিকে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করছে।
*TOB: একটি অস্থায়ী নিরাপত্তা বেস, স্থায়ী দখল নয়*
প্রথমেই বিষয়টি পরিষ্কার করা জরুরি —
TOB কোনো স্থায়ী সেনা ক্যাম্প নয়।
এটি একটি *অস্থায়ী নিরাপত্তা ঘাঁটি*, যা সাধারণত দুর্গম এলাকায় অপারেশন পরিচালনা ও সন্ত্রাসী গতিবিধি নিয়ন্ত্রণের জন্য স্বল্প সময়ের জন্য স্থাপন করা হয়।
যেভাবে সমতলে পুলিশের অস্থায়ী ফাঁড়ি বা পোস্ট স্থাপন করা হয়, পাহাড়ি অঞ্চলে TOB সেই একই ধারণা অনুযায়ী কার্যকর হয়।
পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই TOB সরিয়ে নেওয়া হয় — এটি বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর দীর্ঘদিনের প্রমাণিত রীতি।
*ইউপিডিএফের ষড়যন্ত্র ও বিভ্রান্তি সৃষ্টির প্রচেষ্টা*
TOB স্থাপনের সিদ্ধান্ত ঘোষণার পর থেকেই ইউপিডিএফ এবং তাদের সহযোগী গোষ্ঠীগুলো এলাকায় উত্তেজনা সৃষ্টির অপচেষ্টা চালাচ্ছে।
তাদের প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে সেনাবাহিনীর অবস্থানকে দুর্বল করা এবং নিজেদের অবৈধ আধিপত্য বজায় রাখা।
নিম্নলিখিত ষড়যন্ত্রমূলক কার্যক্রম ইতোমধ্যে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর নজরে এসেছে:
1. *মহিলা ও শিশুদের ব্যবহার করে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি*
— সেনাবাহিনী যখন TOB স্থাপন করতে যায়, তখন ইউপিডিএফ নারী ও শিশুদের সামনে এনে মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে, যাতে সংঘর্ষের চিত্র তুলে ধরে আন্তর্জাতিকভাবে সেনাবাহিনীকে হেয় করা যায়।
2. *ভুয়া জমির দাবি ও ধর্মীয় আড়াল*
— যেখানে TOB স্থাপন হচ্ছে, সেটি “কিয়াং ঘরের জমি” বলে দাবি করা হচ্ছে, অথচ সরকারি রেকর্ড অনুযায়ী জায়গাটি সরকারি খাস জমি।
3. *বন বিভাগের জমি দখলের অপপ্রচার*
— জনগণের মাঝে বিভ্রান্তি ছড়াতে ইউপিডিএফ বলছে, সেনাবাহিনী বন বিভাগের জমি দখল করছে। বাস্তবে এসব তথ্যের কোনো সরকারি প্রমাণ নেই।
4. *বৃহৎ জনসমাবেশের পরিকল্পনা*
— গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী, ১২-১৩ হাজার উপজাতিকে জড়ো করে সেনাবাহিনীর TOB ঘেরাওয়ের পরিকল্পনা রয়েছে। উদ্দেশ্য একটাই— বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি ও আন্তর্জাতিক মিডিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ।
*অর্কিড চাকমা: ইউপিডিএফের ভারত-প্রশিক্ষিত কমান্ডার*
এই পুরো ষড়যন্ত্রের নেপথ্যে রয়েছে ইউপিডিএফের শীর্ষ সশস্ত্র নেতা *অর্কিড চাকমা*।
বিশ্বাসযোগ্য গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, অর্কিড চাকমা ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে একাধিকবার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছে।
সেখানে মণিপুর ও ত্রিপুরার বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলোর সঙ্গে তার সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে।
বাংলাদেশে ফিরে এসে সে বড়মাছড়ি এলাকাকে তার অপারেশনাল সদর দপ্তর হিসেবে ব্যবহার করছে।
অস্ত্র, গোলাবারুদ ও রসদের সরবরাহ এখান থেকেই নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
অর্কিড চাকমার নির্দেশেই বর্তমানে সেনাবাহিনীর TOB স্থাপনকে বাধাগ্রস্ত করতে “ধর্ম ও জমির অধিকার” নামে মিথ্যা প্রচারণা চালানো হচ্ছে।
*কেন সেনাবাহিনীর উপস্থিতি এত গুরুত্বপূর্ণ*
পার্বত্য চট্টগ্রামের নিরাপত্তা বাহিনী কেবল সামরিক শক্তির প্রতীক নয় — এটি রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের রক্ষাকবচ।
সেনাবাহিনী সেখানে উপস্থিত না থাকলে—
* সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর অবাধ চলাচল ও অস্ত্র পাচার বাড়ে,
* সাধারণ পাহাড়ি জনগণ চাঁদাবাজির শিকার হয়,
* উন্নয়ন প্রকল্প বন্ধ হয়ে যায়,
* আইন-শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ে।
অতীত অভিজ্ঞতা বলছে, সেনাবাহিনী ক্যাম্প প্রত্যাহারের পর ইউপিডিএফ ঠিক সেই জায়গাগুলোতে ধর্মীয় উপাসনালয় গড়ে তোলে — যেন ভবিষ্যতে সেখানে আর কোনো নিরাপত্তা ঘাঁটি না স্থাপন করা যায়।
এটি একটি কৌশলগত দখলনীতি, যার ফলে সন্ত্রাসীরা নিরাপদ আশ্রয় পায় এবং সরকারের নিয়ন্ত্রণ দুর্বল হয়ে পড়ে।
*ধর্ম ও মানবাধিকারের নামে অপব্যবহার*
ইউপিডিএফ তাদের রাজনৈতিক ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের আড়াল হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও মানবাধিকারের ভাষা ব্যবহার করে আসছে।
তারা আন্তর্জাতিক মহলে প্রচার চালায় যে “সেনাবাহিনী পাহাড়িদের দমন করছে”, অথচ বাস্তবে সেনাবাহিনীই একমাত্র শক্তি যারা সাধারণ উপজাতি ও বাঙালি উভয়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে আসছে।
ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ব্যবহার করে অস্ত্র মজুদ, আশ্রয় প্রদান, এমনকি অপহরণের পরিকল্পনা— এগুলো এখন প্রকাশ্য গোপন রহস্য।
তাদের এসব কর্মকাণ্ড বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক হুমকি।
*উপসংহার*
বড়মাছড়িতে সেনাবাহিনীর TOB স্থাপন কোনো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নয়, বরং এটি একটি *জাতীয় নিরাপত্তা প্রয়োজনীয়তা*।
যেখানে দেশের সার্বভৌমত্ব, আইনশৃঙ্খলা ও সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা হুমকির মুখে, সেখানে সেনাবাহিনীর উপস্থিতি অপরিহার্য।
ইউপিডিএফ ও অর্কিড চাকমার মতো ভারত-প্রশিক্ষিত নেতৃত্বের লক্ষ্য শুধু সেনাবাহিনীর বিরোধিতা নয় —
তাদের মূল উদ্দেশ্য হলো পাহাড়কে বিচ্ছিন্ন করে রাষ্ট্রবিরোধী কার্যক্রমের ঘাঁটিতে পরিণত করা।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সেই ষড়যন্ত্র বুঝে নিয়েছে।
তারা বিচক্ষণতা ও সংযমের সঙ্গে কাজ করছে, যেন পাহাড়ে শান্তি, উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা যায়।
দেশের প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব হলো এই প্রচেষ্টাকে সমর্থন করা —
কারণ বড়মাছড়িতে TOB স্থাপন শুধু একটি ক্যাম্প নয়, এটি বাংলাদেশের সার্বভৌম অস্তিত্বের এক দৃঢ় প্রতীক।
