বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করতে ‘ফ্যাসিস্ট’ শব্দটি প্রায়ই আলংকারিক গালি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু যখন ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের দেড় দশকের শাসনকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোকে বিশ্লেষণ করা হয়, তখন এই শব্দটি আর শুধু গালি থাকে না—বরং হয়ে ওঠে কাঠামোগত ও তথ্যনির্ভর এক বাস্তবতা। বেনিতো মুসোলিনি, অ্যাডলফ হিটলার কিংবা পল পটের শাসন মডেলের সঙ্গে এ সময়কার নীতির সাদৃশ্য একদিকে বিস্ময়কর, অন্যদিকে উদ্বেগজনক।
ব্যক্তিপূজা ও রাষ্ট্রের একীকরণ
ফ্যাসিবাদের প্রথম বৈশিষ্ট্য হলো নেতা ও রাষ্ট্রকে সমার্থক করে তোলা। শেখ হাসিনাকে ‘উন্নয়নের রূপকার’ থেকে ‘মানবতার মা’ হিসেবে মহিমান্বিত করা হয়। সমালোচনার যেকোনো প্রচেষ্টা চিত্রায়িত হয়েছে রাষ্ট্রদ্রোহিতা বা মুক্তিযুদ্ধবিরোধিতা হিসেবে। রাষ্ট্র, সরকার ও দলকে একাকার করার এই প্রবণতাই ছিল ফ্যাসিবাদী কাঠামোর সূচনা।
দলীয় সন্ত্রাস ও সিন্ডিকেট অর্থনীতি
মুসোলিনির ব্ল্যাকশার্টস বা হিটলারের এসএ বাহিনীর মতো বাংলাদেশে দলীয় ছাত্র-যুব সংগঠনগুলোও রাস্তায় সহিংসতার দায়িত্ব নেয়। বিশ্বজিৎ দাস হত্যাকাণ্ড, বুয়েটের আবরার ফাহাদ হত্যা বা ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে হেলমেট বাহিনীর হামলা এসবের প্রতিচ্ছবি। একইসঙ্গে বিদ্যুৎ খাতে কুইক রেন্টাল, ব্যাংক ঋণ কেলেঙ্কারি ও মেগা প্রকল্পের অস্বচ্ছতা ছিল অনুগত ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট তৈরির হাতিয়ার। জনগণ বহন করেছে এর খরচ, সুবিধাভোগী হয়েছে কেবল ক্ষমতার ঘনিষ্ঠ গোষ্ঠী।
‘অভ্যন্তরীণ শত্রু’ তৈরি ও বিভাজন রাজনীতি
ফ্যাসিবাদ সবসময় দাঁড়িয়ে থাকে ‘আমরা বনাম ওরা’ বিভাজনের ওপর। এখানে যেকোনো সমালোচককে বানানো হয়েছে ‘রাজাকার’, ‘স্বাধীনতাবিরোধী’ বা ‘জঙ্গি’। সমাজকে দ্বিধাবিভক্ত করে রাজনৈতিক মতবিরোধকে জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নে পরিণত করা হয়েছে। ফলে দমননীতি হয়ে উঠেছে বৈধ, আর নাগরিকরা পরিণত হয়েছে শাসকের চোখে শত্রুতে।
প্রচারণার রাজত্ব ও বিকল্প বাস্তবতা
জোসেফ গোয়েবলসের প্রচারণা তত্ত্বের প্রতিফলন দেখা গেছে বাংলাদেশের গণমাধ্যম ও সাইবার স্পেসে। মূলধারার সংবাদমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ, সমালোচনাকারীদের ওপর মামলা-হামলা এবং সরকারের পক্ষে কাজ করা ‘সাইবার আর্মি’—সব মিলিয়ে বাস্তবতাকে আড়াল করে এক বিকল্প কাল্পনিক জগত গড়ে তোলা হয়েছিল।
আইনের শাসন নয়, আইনের দ্বারা শাসন
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (ডিএসএ) ও পরবর্তীতে সাইবার নিরাপত্তা আইন (সিএসএ) ছিল দমনমূলক অস্ত্র। লেখক মুশতাক আহমেদের মৃত্যুর মতো ঘটনা এই আইনের ভয়াবহতা প্রকাশ করেছে। বিচার বিভাগ ও নির্বাচন কমিশনকে দলীয় প্রভাবের অধীনে আনা হয়েছিল, যা শেষ পর্যন্ত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে পুরোপুরি অকেজো করে তোলে।
ভয় ও সন্ত্রাসের রাজনীতি
গুম, ক্রসফায়ার ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ছিল ভয় প্রতিষ্ঠার হাতিয়ার। মানবাধিকার সংস্থার তথ্যমতে শত শত মানুষ গুমের শিকার হয়েছেন, যাঁদের অধিকাংশই বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী। যুক্তরাষ্ট্র পর্যন্ত এ কারণে র্যাব ও এর কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়।
নির্বাচনী প্রহসন
২০১৪ সালের ভোটারবিহীন নির্বাচন, ২০১৮ সালের ‘নিশিরাতের ভোট’ এবং ২০২৪ সালের ‘ডামি নির্বাচন’ প্রমাণ করেছে, নির্বাচনী প্রক্রিয়া কেবল বৈধতার মুখোশ। গণতন্ত্রের আত্মা ছিল শ্বাসরুদ্ধ।
জুলাই-আগস্টের গণহত্যা: চূড়ান্ত রূপ
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ফ্যাসিবাদী চরিত্র সবচেয়ে নৃশংসভাবে প্রকাশিত হয়। জাতিসংঘের তথ্যমতে, ওই সময়ে প্রায় ১,৪০০ মানুষ নিহত হন, যাদের মধ্যে শিশু পর্যন্ত ছিল। ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউট, কারফিউ এবং প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ পুরো রাষ্ট্রকে পরিণত করে ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞের মেশিনে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো একে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে।
২০০৯ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত সময়কালের শাসনব্যবস্থা ফ্যাসিবাদের প্রতিটি মানদণ্ড পূরণ করেছে—ব্যক্তিপূজা, দলীয় সন্ত্রাস, সিন্ডিকেট অর্থনীতি, বিভাজন রাজনীতি, দমনমূলক আইন, ভয়ের সাম্রাজ্য এবং নির্বাচনী প্রহসন। জুলাই-আগস্টের গণহত্যা ছিল সেই শাসনের চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ, যা ইতিহাসে এক অন্ধকার অধ্যায় হয়ে থাকবে।
এখন দেশের সামনে নতুন এক অধ্যায়। সময় এসেছে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার, জনগণের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার। অন্তর্বর্তী সরকার ইতিমধ্যেই ঘোষণা দিয়েছে—আগামী ফেব্রুয়ারিতে হবে অবাধ ও সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচন। রাজনৈতিক দলগুলো প্রস্তুতি নিচ্ছে, আর জনগণ অপেক্ষা করছে সেই দিনের জন্য, যখন প্রকৃত গণতন্ত্র আবারও প্রতিষ্ঠিত হবে এই দেশে।